গপ্পে শ্যামাঃ
আমি চোর, বাংলা কথায় আমি ভাত চোর, হ্যাঁ শুধু ভাতই চুরি করি। আর কিছু নাহ। আমি চুরি করে খাই, পেটের দায়ে চুরি করি। আমার থাকার জায়গা দুনিয়ায় সব জায়গায়৷ যেখানে ইচ্ছে যাই, যেখানে ইচ্ছে ঘুমাই, রাস্তার ধারে,বস্তিতে,রেল লাইনের ধারে, সারাদিন ঘুরে বেড়াই, আর কানু বিড়ি খাই, সারাদিন পর যখন ভাতের খুদা লাগে তখন চুরির নেশায় মেতে উঠি।
একদিন সন্ধ্যায় মনস্থির করলাম, আজ হাটতে হাটতে যত দুর যেয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নামবে, সেই বাড়িতেই চুরিটা করবো, যেই কথা সেই কাজ, হাটতে হাটতে এক সময় দেখলাম গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। আর আমার ঠিক সামনে একটা বড়ও বাড়ি, ঠিক করলাম এই বাড়িতেই চুরিটা করবো।
তারপর আস্তে আস্তে পা টিপতে টিপতে বড় বাড়ি ভিতর ঢুকে পড়লাম, ঢুকেই চুরি করে নিরাপদে বের হয়ে আসার রাস্তা দেখে নিলাম।
এ ঘর থেকে ও ঘরে খুজতে লাগলাম ঘরের ভেতরে ডুকার কোন উপায় খুজে পাচ্ছিলাম না, এভাবে অনেক সময় চলে গেল।
হঠাৎ কারো ফিসফিস করে কথা বলা শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে হাতের সোনার বালাটা তোমার পছন্দ হয় নাই সোনা, মেয়ে কন্ঠে বলছে হুম, হইছে তো, পুরুষ কন্ঠে বলছে, কি হইছে, মেয়ে কন্ঠে বলছে, সোনার বালাটা খুব পছন্দ হইছে, যদিও চাইছিলাম সোনার হাড় আর তুমি দিলা সোনার বালা! পুরুষ কন্ঠে বলছে এবার আমারটা দাও সোনা, মেয়ে কন্ঠে বলছে কি, কি দেব! পুরুষ কন্ঠে বলছে বুঝনা সোনা আমার, একটু আদর সোহাগ দাও।
এত কষ্ট করে সোনার বালা গড়াইয়া দিলাম, আর একটু আদরও পাব না, পোড়া কপাল আমার, মেয়ে কন্ঠে বলছে যাও সখ কত! পুরুষ কন্ঠে বলছে, সত্যিই একটু আদর সোহাগ দিবানা সোনা! মেয়ে কন্ঠে বলছে ঠিক আছে দিব, তবে এক স্বর্থে, পুরুষ কন্ঠে বলছে এক স্বর্থে কেন, হাজারটা স্বর্থ বল সব মানবো সোনা, আমি কি তোমার কোন সাদ আহ্লাদ অপূর্ণ রাখছি সোনা।
মেয়ে কন্ঠে বলছে তাহলে বল, কবে আমার সোনার হার গড়াই দিবা, পুরুষ কন্ঠে বলছে ঠিক আছে সামনে ধান কেটে গোলায় তোলার আগে, তোমার সোনার হার গড়াইয়া দিব ধান বেচে, তারপর বাকি ধান গোলায় তুলবো, কথা দিলাম, হ্যাঁ কথা দিলাম তো সোনা।
তারপর মেয়ে কন্ঠে বলছে, ওরে আমার লক্ষী সোনা, তুমি এতো ভালো কেন, তোমার ঘরে সত্যিই আমি অনেক সুখি গো, বলেই পুরুষ টার গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হাসতে লাগলো দুজনে মিলে।
আর অনেক গুলো চুমুর শব্দ শুনা যাচ্ছিল, আর এভাবে তাদের রঙ্গ রসের লীলা খেলা দেখতে দেখতে অনেক সময় চলে গেলে।
হঠাৎ আমি জানালার পাল্লা ভেঙে পড়ে গেলাম, সাথে সাথে তারা দুইজন, চোর চোর বলে চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো।
আমি কোন উপায় অন্তর না দেখে দিলাম ভ্রো দৌড়। মুহুর্তেই দেখলাম আমার পিছনে শতশত মানুষ দৌড়াচ্ছে।
কখন যে একটা ঝুপড়ি ঘরে ডুকে পরেছি বুঝতেই পারিনি, শুনতে পারছিলাম, শতশত মানুষের পায়ের আওয়াজ, একসময় পায়ের আওয়াজ থেকে গেলো, আর আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম ভাতের হাড়ি, সাথে সাথে মনে হলো আমি যেন বেহেস্তে আছি, ঝুপড়ি ঘরটা একটা আস্ত বেহেস্ত।
হাড়িটা খুলে দেখি হাড়ি ভর্তি পান্তা, তখন নিজেকে খুব চালাক মনে হলো, শতশত মানুষ আমাকে ধরতে পারলো না। আর আমি আমার চুরি বস্তু ঠিকই পাইছি, ওহ খুদায় পেটে নরকের আগুন লাগছে আগে খাইয়া লই। তারপর ইচ্ছে মত হাড়ির সব পান্তা খাইয়া সবাড় করে দিলাম।
পান্তা ভাত খেয়ে শরীর টা অনেক ভারি হয়ে গেলো, আজ যে দৌড়ানি খাইলাম। তারপর ক্লান্তিতে দুই চোখে জম্মের ঘুম চলে এলো, আর সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
কারণ খাওয়ার পরে আমার, যেখানেই রাইত সেখানেই কাইত।
আমি দেখলাম ভোরের আলো ফুটেছে, অনেক মানুষ একজন মানুষ কে ঘিরে ধরে আছে, মানুষ টা মাটিতে চিত হইয়া পইরা আছে, তার নাখ, মুখ ফাটা, কি রক্ত, কত রক্ত, কি বিভর্ষ চেহারা, মনে হয় হাতুড়ি দিয়া পিটাতে পিটাতে, নাখ মুখ থেঁতলে দিছে, আর সারা শরীরে কত যে রক্ত, আর ফাটা বাশের মত সারা শরীর, দেখতে আমার শরীরটাই ঘিনঘিন করছে।
অনেক লোকের ফাকে একজন বলে উঠলো, এইটা ঘুঘু নাহ, ঘুঘু ই তো, হ্যাঁ ঠিক ধরছি, এটা তো আমাদের সেই ঘুঘু পাগলা। কোথায় থাইকা যে আসছিলো একদিন, কেউ কইতে পারত না, কি নাম, পরিচয় কেউ জানতো না।
সারাদিন ঘুইরা বেড়াই ত, আর ঘুঘুর মত ডাকতো, সে তার নামও জানত না, তাই সবাই তার নাম দিল, ঘুঘু পাগলা। কত মানুষ যে তাকে সারাদিন কামলা খাটাইতো, কোন টাকা দিত না। অবিশ্য ঘুঘু পাগলা, টাকা কি বুঝতই না। শুধু কইতো, কাম কইরা দিবনি, তালি ভাত দিবুনি, ভাত দে, আর আমি কাম করি, হা হা হো হহ। তারপর একিদিন হঠাৎ করে ঘুঘু পাগলা উধাও হয়ে গেলো, কেই তার খবর জানলো না।
আর আইজকা, সবাই মিলে তোমরা ঘুঘু পাগলা রে এই রকম নিষ্ঠুরভাবে হাতুড়ি দিয়া থেঁতলা করার মত কইরা, বাঁশ দিয়ে পিটাইয়া একেবারে মাইরাই ফেললা। হায়রে নিষ্ঠুর মানুষ তোমরা, কত অকৃতজ্ঞ মানুষ, কেই কি আছো এই গ্রামে, যে এক দিনও এই ঘুঘু পাগলা কে দিয়া বিনে পয়সায়, মাগনা সারাদিন কাম করাও নাই। খালি একটু পান্তা ভাত দিতা, সারাদিন খাটাইয়া একদিনও গরম ভাত দেও নাই, কেউ কি আছো, থাকলে বুকে হাত দিয়া কও, দিছিলা এক বেলা গরম ভাত।
কতদিন পর এই গ্রামে ঘুঘু আইছিলো, একটু পান্তা ভাত খাইতে আর তোমাদের ঘুঘুর মুধুর ডাক শুনাইতে, শুন নাই, তোমরা শুন নাই, ঘুঘু রে মাঝে বসাইয়া গোল হইয়া বইসা থাইকা ঘুঘুর ডাক, শুন নাই, তোমরা সবাই তো শুনতাও, আর আজ তোমরা সবাই মিলা রাইতের আন্ধারে ঘুঘুটারে পিটাইয়া মাইরা ফেললা।
তারপর লোকটা বুক চাপড়াইতে চাপড়াইতে আর্তনাদ করতেই লাগলো, তখন ঘুঘু পাগলাকে ঘিরে থাকা, সব লোকেরা চোখের পানি মুছতে ছিলো এক হাতে, আর অন্য হাতে বাশ। আমি দেখলাম একি আমিও তো ঘুঘু পাগলা রে চিনি। আমার লাহান নি তো দেখা যায়, এটা কি আমি ঘুঘু পাগলা, যে কিনা এই গ্রামের প্রত্যক মানুষকে ঘুঘুর ডাক শুনাইয়া আনন্দ দিতো।
[বিঃ দ্রঃ বার্তা -আমাদের সমাজে কি এভাবে মনুষ্যত্ব গলে পঁচে যায় নি, যে সামান্য এক ঘুঘু পাগলা শুধু পান্তা ভাত খেয়ে পেটে খুদা নিবারণ করতে গিয়ে চুরি করতে বাধ্য হয়, আর সমাজে একটা মানুষকে একটু পান্তা ভাত খেতে না দিয়ে হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে মেরে ফেলা হয়।]