সেই ভয়ঙ্কর দৈত্যাকার সর্বগ্রাসী রাক্ষসটাকে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল! দেখা গেল, তার সর্বনাশা খিদে মেটাতে মহাকাশে কী ভাবে বিশাল বিশাল নক্ষত্রদের হাড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা গিলে নিচ্ছে। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোনও খাবারই ফেলে রাখছে না সেই রাক্ষস। বহু চেষ্টাচরিত্র করে দু’বছর ধরে তার ছবি তোলা হয়েছে। যে ছবি প্রকাশ করা হবে এই এপ্রিলেই।
সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসটা রয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের ঠিকানা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে। আমাদের থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। রাক্ষসটার নাম- ‘স্যাজিটেরিয়াস এ*’। যে আসলে একটি দৈত্যাকার সর্বগ্রাসী ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। যাকে দেখার আগ্রহ আমাদের প্রায় এক শতাব্দী ধরেই!
এমন ভয়ঙ্কর দৈত্যাকার রাক্ষসের ছবি তোলার মতো অসাধ্যসাধনটা করেছে ইভেন্ট হরাইজ্ন টেলিস্কোপ (ইএইচটি)। যা বানানো হয় পৃথিবীর ৮টি মহাদেশে বসানো অত্যন্ত শক্তিশালী ৮টি রেডিও টেলিস্কোপের নেটওয়ার্ক দিয়ে। কাজ শুরু করেছিল ২০১৭-য়।
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের (আইসিএসপি) অধিকর্তা, দেশটির বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘ওই ছবির জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। রয়েছি দারুণ উত্তেজনায়। কারণ, একটি বিরলতম ঘটনা ঘটতে চলেছে। যা ব্রহ্মাণ্ডের অনেক জটিলতম রহস্যের জট খুলে দিতে পারে।’’
আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, শুধুই আমাদের গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে থাকা ব্ল্যাক হোলটিরই ছবি তোলেনি ইভেন্ট হরাইজ্ন টেলিস্কোপ, ছবি তুলেছে আরও একটি বিশাল গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে থাকা আরও ভয়ঙ্কর আরও বড় চেহারার একটি রাক্ষসেরও। সেই গ্যালাক্সির নাম- ‘এম-৮৭’। যা আমাদের চেয়ে রয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। দু’টি রাক্ষসেরই বিরলতম ছবি অনলাইনে প্রকাশ করা হবে এই এপ্রিলে।
কেন এত দিন ছবি তোলা সম্ভব হয়নি ওই রাক্ষসদের?
কাউকে আমরা তখনই দেখতে পাই, তার ছবি তখনই তুলতে পারি, যখন কারও থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে আলো। যাকে বলে প্রতিফলন। কিন্তু ব্ল্যাক হোল এমনই একটি মহাজাগতিক বস্তু যার সর্বগ্রাসী খিদের হাত থেকে কারওরই রেহাই মেলে না। এমনকি, বেরিয়ে আসতে পারে না আলোও। ব্ল্যাক হোল তার অত্যন্ত শক্তিশালী অভিকর্য বলের টানে সব কিছুকেই তার দিকে টেনে নিয়ে আসে। তার পর গপাগপ তাদের খেয়ে ফেলে। যাদের কাছে টেনে নিয়ে আসে ব্ল্যাক হোল, তাদের কাউকেই আর পরে দেখা যায় না তারা ব্ল্যাক হোলের ‘পেটে’ চলে গেলে। তাই এই ব্রহ্মাণ্ডের কোনও ব্ল্যাক হোলেরই ছবি তোলা সম্ভব হয়নি এত দিন।
‘ব্ল্যাক হোল্স আর নট সো ব্ল্যাক’!
প্রয়াত কিংবদন্তি পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংই প্রথম অঙ্ক কষে বলেছিলেন, ‘‘ব্ল্যাক হোলস আর নট সো ব্ল্যাক।’’ ব্ল্যাক হোলরা পুরোপুরি কালো হয় না। তাদেরও কিছুটা ‘আলো’ থাকে। সেই আলোটা অবশ্য দেখা সম্ভব হয় না। কারণ, সেই আলোটা বেরিয়ে আসে অসম্ভব ঠান্ডায়। অথচ তার চেয়ে অনেক বেশি গরম এই ব্রহ্মাণ্ডের কসমোলজিক্যাল মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি)। চার পাশের তুমুল হইহল্লায় যেমন শিশুদের কান্না চাপা পড়ে যায়, তেমনই সিএমবি-র তাপমাত্রায় ব্ল্যাক হোলের সেই মিনমিনে আলোও ঢাকা পড়ে যায়। তাকে দেখা সম্ভব হয় না। সেই ‘আলো’র ও-পারে কি আছে (যেখানে রয়েছে বল্যাক হোল) তাও জানা যায় না। দেখা যায় না। শুধু বোঝা যায়, ও-পারে যেন কিছুই নেই। রয়েছে শুধুই শূন্যতা।
ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি যে জায়গাটা থেকে কিছুটা হলেও আলো বেরিয়ে আসতে পারে, স্টিফেন হকিং সেই জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন ‘ইভেন্ট হরাইজ্ন’। যা রয়েছে গোটা ব্ল্যাক হোলটার চার পাশে। ব্ল্যাক হোলটাকে চার দিক থেকে ঘিরে। যেন সেই ইভেন্ট হরাইজ্নটাই প্রদক্ষিণ করছে গোটা ব্ল্যাক হোলটাকে!
ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজ্নে আলো আসে কোথা থেকে?
সব সময়েই ‘খাই খাই’ অবস্থায় থাকে ব্ল্যাক হোল। কখনওই তার খিদে কমে না। পেটও ভরে না। চার পাশে থাকা কোনও গ্যালাক্সির যে নক্ষত্র, ধুলোবালি, ধুলো আর গ্যাসের মেঘকে তার অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে কাছে নিয়ে আসে ব্ল্যাক হোলগুলি, সেগুলি ব্ল্যাক হোলের পেটে গিয়ে পড়ার আগে ছুটে আসার সময় একে অন্যকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা মারে ব্ল্যাক হোলের চার পাশে থাকা ধুলোবালি আর জমাট বাঁধা গ্যাসের মেঘকে। তার ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরনের আলোর। যাকে বলা হয় এক্স-রে। যা আমরা দেখতে পাই না। তবে সেগুলিও তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। যা খুব বেশি দূর যেতে পারে না। তাই খুব দূর থেকে তা দেখা সম্ভব হয় না আমাদের। এমনকি, আমাদের হাতে তেমন কোনও শক্তিশালী টেলিস্কোপ এখনও পর্যন্ত নেই, যা দিয়ে ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজ্ন থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা সেই এক্স-রে দেখা সম্ভব।
এ বার কী ভাবে সেই ছবি তোলা সম্ভব হল?
সন্দীপ জানাচ্ছেন, প্রচুর আধানযুক্ত কণা ইভেন্ট হরাইজ্নে থাকে বলে ব্ল্যাক হোলের চার পাশের ওই এলাকায় অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিন্ডের জন্ম হয়। সেই শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে দিয়ে ইভেন্ট হরাইজ্ন থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে আরও এক ধরনের আলো। যা আসলে রেডিও তরঙ্গ। যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক গুণ বেশি। তা অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। যা এক্স-রে পারে না।
সেই রেডিও তরঙ্গকে দেখেই ব্ল্যাক হোলের চেহারাটা বুঝতে পারা সম্ভব। পৃথিবীর ৮টি মহাদেশে বসানো অত্যন্ত শক্তিশালী ৮টি রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে সেই রেডিও তরঙ্গকেই দেখা হয়েছে। তার ফলে, এত দিনে ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে ব্ল্যাক হোলের।
সেই ছবি কেমন হতে পারে?
সন্দীপ বলছেন, ‘‘নিখুঁত ছবি তোলার জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত শক্তিশালী রেজোলিউশনের। আর প্রয়োজন উৎস থেকে বেরিয়ে আসা আলোর কণা ফোটনের পর্যাপ্ত পরিমাণ। যথেষ্ট আলো বেরিয়ে না আসলে তাকে দেখা সম্ভব নয়। কারণ আমরা দেখছি ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে! আর একটি ব্ল্যাক হোলকে দেখা হয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে।’’
সন্দীপ এও জানাচ্ছেন, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির ঠিক মাঝখানে থাকা ব্ল্যাক হোলটির ছবি কতটা নিখুঁত হবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় রয়েছেন তিনি। কারণ, আমাদের গ্যালাক্সির রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল স্যাজিটেরিয়াস-এ* ততটা খাবারদাবার পায় না। ইচ্ছে থাকলেও পায় না। কারণ, তার চার পাশে রয়েছে অনেক বড় বড় নক্ষত্র ও নক্ষত্রপুঞ্জ। যারা কেউই ততটা ছন্নছাড়া নয়। অনেক দিন আগেই নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। তাই খিদে মেটাতে চট করে তাদের কাছে টেনে আনতে পারে না আমাদের ব্ল্যাক হোল। তুলনায় ‘এম-৮৭’ গ্যালাক্সিতে থাকা ব্ল্যাক হোলটি অনেক অনেক গুণ বড়। অনেক অনেক গুণ ভারী। আর সে অসম্ভব রকমের পেটুক। খিদে মেটাতে সে প্রচুর খাবারদাবারও পায় নিয়মিত। ফলে, সেই ব্ল্যাক হোলের চার পাশে ইভেন্ট হরাইজ্নে এক্স-রে আলো অনেক জোরালো হবে আমাদের ব্ল্যাক হোলের চেয়ে। আর সেই ব্ল্যাক হোলের চৌম্বক ক্ষেত্র অনেক অনেক গুণ বেশি জোরালো হওয়ায় সেখান থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা রেডিও তরঙ্গ অনেক বেশি জোরালো হবে। তাই ‘এম-৮৭’ গ্যালাক্সির ব্ল্যাক হোলের ছবি অনেক ভাল ভাবে পাওয়া সম্ভব, যদিও সে আমাদের চেয়ে রয়েছে অনেক অনেক বেশি দূরে।
এই ছবি ব্রহ্মাণ্ড-রহস্যের কোন কোন জট খুলে দেবে?
সন্দীপের কথায়, ‘‘ব্ল্যাক হোলের পেটে ঢুকে হাপিশ হয়ে যাওয়ার পর নক্ষত্র-সহ যাবতীয় মহাজাগতিক বস্তু কোথায় চলে যায়, তা কি ‘ওয়ার্মহোল’-এর মধ্যে দিয়ে চলে যায় অন্য আরও কোনও ব্রহ্মাণ্ডে, ভবিষ্যতে তা জানারও পথ খুলে দেবে এই ছবি। পাশাপাশি জানা যাবে, যে আইনস্টাইন এখনও হারেননি ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ম-নীতির কাছে, তাঁর সেই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ কি শেষ পর্যন্ত হার মানে ব্ল্যাক হোলেই, যেখানে স্থান-কাল (স্পেস-টাইম) বলে আর কিছুই থাকে না। তার লয় (বিনাশ) হয় পুরোপুরি।’’
জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরা বহ দিন ধরেই ধন্দে রয়েছেন একটা ব্যাপার নিয়ে। তা হল, সব রকমের মহাজাগতিক বস্তুই যদি ব্ল্যাক হোলের পেটে ঢুকে হাপিশ হয়ে যায়, তা হলে তো এই ব্রহ্মাণ্ডের শক্তির ভারসাম্যটাই থাকবে না। মেনে নিতে হবে শক্তিরও বিনাশ হয়। কিন্তু তা তো হয় না। তা হলে কি ব্ল্যাক হোলে ঢুকে অন্য কোনও ব্রহ্মাণ্ডে চলে যাচ্ছে হাপিশ হয়ে যাওয়া নক্ষত্র-সহ বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুরা?
সেই প্রশ্নটার জবাব পাওয়ার জন্য এ বার দৌড়টা অন্তত শুরু করা যাবে। এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।-আনন্দবাজার