কলকাতায় বসেই বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন খুনী আব্দুল মাজেদ। এজন্য তিনি ব্যবহার করতেন ভিন্ন নামে কেনা একাধিক সিমকার্ড এবং সিক্রেট অ্যাপ।কানাডায় পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর সাথে নিয়মিত ফোনে কথা বলতেন মাজেদ। বর্তমানে ইউরোপের কোনো একটি দেশের পাসপোর্টধারী ডালিমের সাথেও ছিল যোগাযোগ। এছাড়া লন্ডনে দুই ব্যাক্তির সাথেও নিয়মিত কথা বলার যাবতীয় তথ্য প্রমান পেয়েছে গোয়েন্দারা। তবে লন্ডনে যাদের সাথে মাজেদ কথা বলতো তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে তদন্ত চলছে। একাধিক বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
পাকিস্তানে পালিয়ে থাকার বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী আব্দুর রশীদ ও তার মেয়ে মেহনাজ রশীদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল মাজেদের। কয়েকদিন আগে ফাঁসি কার্যকর হবার পর অন্য খুনীদের সাথে যোগাযোগসহ তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং নেটওয়ার্কের বিষয়ে একের পর এক বেরিয়ে আসছে গুরুত্বপুর্ণ তথ্য।
সূত্রটি জানিয়েছে, মাজেদ ভিন্ন ভিন্ন সিমকার্ড দিয়ে সবচেয়ে বেশি কল করতেন লন্ডনে। আবার সেই একই নাম্বার থেকে ফোন আসতো মাজেদের কাছেও।এসব ফোন কলের ভয়েস রেকর্ড উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনীদের সাথে মাজেদের যোগাযোগ আছে এমন তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশের গোয়েন্দারাও। ভারতের গোয়েন্দাদের কাছ থেকে জানার পর মাজেদের লন্ডন কানেকশানের ব্যাপারে তথ্য উদ্ধার করতে কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
তবে দু’দেশের গোয়েন্দাদের কাছে আরো ভয়ংকর তথ্য আছে বঙ্গবন্ধুর পালিয়ে থাকা খুনীদের সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের সাথে পালিয়ে থাকা ফাঁসির দ-প্রাপ্ত খুনীরা জড়িত এমন তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে আগে থেকেই ছিল। তবে তাদের ইন্ধনদাতা, পরিকল্পনাকারী ও অর্থায়নকারীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে হত্যার চক্রান্ত করেছিল একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্টি। একটি জাহাজে করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গ্রেনেড। বঙ্গপোসাগরের ভারতীয় সীমান্তের অদূরে ওই জাহাজটিতে আকষ্মিক বিষ্ফোরণ ঘটে এবং সম্পুর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকার জানলেও ভারতীয় মিডিয়ায় আসে নির্বাচনের কিছুদিন পর। জানা যায় জাহাজটিতে বিষ্ফোরণ এমনি এমনি ঘটেনি। বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজটিকে ধ্বংসের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত ছিল এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিরাপদে রাখা। পরে হত্যার চক্রান্ত এবং জাহাজে অস্ত্র পাঠানোর অর্থায়নকারীদের ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে দু’দেশের গোয়েন্দারা লন্ডন কানেকশন খুঁজে পায়। এ ব্যাপারে কিছু তথ্য প্রমাণ পাবার পর থেকে সেই ব্যক্তি তখন থেকেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজরদারিতে রয়েছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, খুনী মাজেদ কলকাতায় থাকাকালীন লন্ডনে যাদের সাথে কথা বলতেন সেই ভয়েস রেকর্ড উদ্ধার করতে পারলে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের অর্থায়নকারীদের খুঁজে বের করতে আরো সহজ হবে। তবে সূত্রটি আরো জানিয়েছে, বাংলাদেশের গোয়েন্দারা এই তথ্য উদ্ধারের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
অন্যদিকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলাদেশে তার প্রথম স্ত্রী-সন্তানদের সাথে ছাড়াও আরো কয়েকজনের সাথে নিয়মিত ফোনে কথা বলতেন বঙ্গবন্ধুর খুনী মাজেদ। গোয়েন্দারা সেইসব নাম্বারের মালিকদের নাম পরিচয় জানতে পেরেছে। গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা ওইসব ব্যাক্তিরা যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন।
১৯৭৫ সালের ১৫আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যার পর নভেম্বরে দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত অন্য খুনিদের সঙ্গে বঙ্গভবনেই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে মাজেদ। পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি ব্যাংকক হয়ে পাকিস্তান এবং পরে লিবিয়া চলে যান। মাজেদ সে সময় লিবিয়ায় কয়েকমাস ছিলেন। এরপর পুরস্কার হিসেবে তাকেসহ অন্য অনেককে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। মাজেদকে চাকরি দিয়ে পাঠানো হয় সেনেগালের বাংলাদেশ দূতাবাসে।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনীদের পরামর্শে সে বছরের শেষের দিকে পাকিস্তান থেকে লিবিয়া হয়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করে মাজেদ। পার্কস্ট্রীটের বেডফোর্ড লেনের এই বাসায় আসার পর তৎকালীন সময়ে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। হাইকমিশনের একাধিক কর্মকর্তার অফিসকক্ষে ছিল মাজেদের নিয়মিত যাতায়াত। কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও নিয়মিত যোগ দিতেন। কোনো কোনো কর্মকর্তার বাসায় গভীর রাত পর্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যাক্তির সাথে আড্ডা দিত। মাজেদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল এমন সাবেক এক কর্মকর্তা বর্তমানে সপরিবারে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
ঘনিষ্ঠতা ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মাজেদ হাই কমিশনের গুরুত্বপুর্ণ কোনো তথ্য হাতিয়ে নিতেন কি না তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। হাইকমিশনে স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত কর্মচারিদের সাথে মাজেদের ছিল বিশেষ সখ্যতা। কারো কারো বাসায় যাতায়াত ছিল তার। তাদের অনেকেই এখনও কর্মরত আছেন উপ-হাইকমিশনে। তবে উপ-হাইকমিশনের বর্তমান টিমের সাথে অনেক চেষ্টা করেও সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি। এই টিমের তৎপরতার কারণে মাজেদের নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সে বেশিরভাগ সময়ই ঘর থেকে বের হতো না।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনী আব্দুল মাজেদ ওরফে আহমেদ আলীর সাথে কাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল সেই তদন্তে মাঠে নেমেছে কলকাতা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একাধিক টিম। পরিচয় লুকিয়ে কিভাবে তিনি কিভাবে আধার কার্ড এবং ভারতীয় পাসপোর্ট করেছেন তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। পার্কস্ট্রীটের বেডফোর্ড লেনের ওই বাসায় আহমেদ আলি নামে মাজেদকে অনেকেই চিনতো ইংরেজির মাষ্টারমশাই হিসেবে। কয়েকজন ছোট বাচ্চাকে ইংরেজি পড়িয়ে তার সংসার চলার কথা না। অথচ মোটা অংকের টাকা সুদে খাটাতেন তিনি। সম্প্রতি তালতলা এলাকায় ২৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট বুক করেছিলেন মাজেদ। সাইফুদ্দিন ওরফে আলী নামের এক ব্রোকারের মাধ্যমে আরও একটি ফ্লাট কেনার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার অর্থের উৎস খুঁজতে মাঠে নেমেছেন দু’দেশের গোয়েন্দারাই। মাজেদের কাছ থেকে টাকা বাংলাদেশ থেকে নাকি লন্ডন থেকে পাঠানো হতো তা জানা যাবে শীঘ্রই ।