এ বছরের মার্চে প্রকাশিত ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছিল, ঘর ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের রাখাইনে বৌদ্ধ মডেল গ্রাম গড়ে তুলছে মিয়ানমার। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানী খবরে সেই খবরের অগ্রগতি জানা গেল। রাখাইনের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে তারা জানিয়েছে, একসময়ের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলোতে এরইমধ্যে নাটকীয় রূপান্তর ঘটেছে। আগুন আর বুলডোজারে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত নিশ্চিহ্ন করার পর সেখানে শত শত নতুন ঘর-বাড়ি গড়ে তুলছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। আর তাতে পুনর্বাসিত হচ্ছে বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গা গ্রামগুলো রূপান্তরিত হচ্ছে বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রামে। রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্রমাগত ফুরিয়ে আসছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি করলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পালিয়ে আসা ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে কেবল ৮ হাজার জনের তালিকা হয়েছে প্রত্যাবাসনের জন্য। মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে না পারায় ফিরে যেতে রাজি হয়নি প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারাও। ন্যায়বিচার, নাগরিকত্ব এবং নিজ গ্রামে ফেরা ও ভূমির অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবি পূরণের আগে মিয়ানমার যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ধারাবাহিকভাবে সতর্ক করে আসছিল, রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংস করে বৌদ্ধ গ্রাম ও নিরাপত্তা বাহিনীর ঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে। মিয়ানমারের দাবি, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরবেন, তাদের জন্যই পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে। এএফপি’র মার্চের অনুসন্ধান থেকে জানা গিয়েছিল, বুলডোজারে রোহিঙ্গা স্মৃতি মুছে দিয়ে বিপুল সামরিকায়িত রাখাইনে এখন বৌদ্ধ মডেল গ্রাম নির্মাণ করা হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে, রাখাইন-বৌদ্ধদের অর্থায়ানে পরিচালিত সংস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গাশূন্য রাখাইন গড়ে তোলার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল তখন। এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পনা জানতে গত এক বছর ধরে রাখাইনে চলা নির্মাণ কাজের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স। মিয়ানমার সরকারের খসড়াকৃত ও অপ্রকাশিত একটি পুনর্বাসন মানচিত্রও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি পুনর্বাসন নীতিমালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ত্রাণকর্মী, বাংলাদেশের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং এখনও রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রয়টার্স সাংবাদিকরা। সবমিলে তাদের প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে, তা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি আর এএফপির প্রতিবেদনেরই ধারাবাহিকতা। স্থানীয় কর্মকর্তা ও নতুন বসতি স্থাপনকারীদেরকে উদ্ধৃত করে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, একইসঙ্গে নতুন ঘর-বাড়ি তৈরি ও বৌদ্ধদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছে মিয়ানমার সরকার। এ ক্যাম্পেইনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা। তারা ওই এলাকাকে বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত করতে চায়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা পুনর্বাসন নিয়ে যে খসড়া মানচিত্র তৈরি করেছে তাতে দেখা যায়, রাখাইনে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গারা তাদের মূল বাড়ি কিংবা গ্রামে ফিরে যেতে পারবে না। তাদেরকে দেশের অন্য মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন রোহিঙ্গা বসতি কেন্দ্রে রাখা হবে। জাতিসংঘের এক অভ্যন্তরীণ নথিকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, রাখাইনে এখনও দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তাদের অনেকের অভিযোগ, অবস্থা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। খুব সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৪ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়টার্সকে জানায়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে হুমকি-ধামকি দিয়েছে ও মারধর করেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় কারফিউ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় কাজ করা ও খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর বাংলাদেশে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন হুসেইন আহমেদ। ইন দিন গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। স্যাটেলাইট চিত্র দেখে নিজের গ্রামকে শনাক্ত করতে পারছিলেন না। রয়টার্সকে তিনি জানান, গ্রামটি পুরোপুরি অচেনা হয়ে পড়েছে। সব মুসলিম বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। বৌদ্ধ বাড়িগুলো আছে। তার বাড়ি কোথায় ছিল সে জায়গাটি স্যাটেলাইট চিত্রে খুঁজে বের করেন হুসেইন। সে জায়গায় এখন দুই তলা বাড়ি নির্মিত হয়েছে। রয়টার্সকে হুসেইন বলেন, নিজের ভূমি ফিরে না পেলে প্রত্যাবাসিত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। ‘এটা আমার গ্রাম ছিল। আমাদের সব বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী আমাদের জমি দখল করেছে। আমার মনে হয় না তা আর ফেরত পাব।’ বলেন হুসেইন আহমেদ। কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও রোহিঙ্গাদেরকে বেশিরভাগ রাখাইন বৌদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বিবেচনা করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ ঘৃণার চাষাবাদ করেছে দীর্ঘদিন। বিদ্বেষের শেকড় তাই দিনকে দিন আরও শক্ত হয়েছে। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। এবার বৌদ্ধ পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে রাখাইনকে রোহিঙ্গা শূন্য করা হচ্ছে।