মো. কামরুজ্জামান, নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি: নেত্রকোনায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এক শ্রেণির অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র বিশেষ করে লোকালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকা ও ফসলি জমিতে অবৈধ ভাবে গড়ে তুলছে ইট ভাটা।এসব ইট ভাটায় নেই কোন সরকারি অনুমোদন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, গ্যাস ও ধুলায় জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে।হারিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র্য, বিনষ্ট হচ্ছে আমাদের চির চেনা প্রকৃতি ও পরিবেশ।
২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে সংশোধনী এনে ইট ভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক, নির্দিষ্ট এলাকায় ইট ভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ, লাইসেন্সবিহীন ইট ভাটা চালালে দুই বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান সংযোজন করে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন আইন, ২০১৯’ বিল সংসদে পাস হয়েছে। ধারা-৪ এ সংশোধন এনে প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ইট ভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিতে পারিবে না।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনা জেলায় আনুমানিক ৬০টি ইট ভাটা রয়েছে। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ২৪টি ইট ভাটা লাইসেন্স নিয়ে বৈধ ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার ফকিরের বাজারের উত্তর পাশে ওমির ব্রিক্স সরকারের কোন নিয়ম শৃঙ্খলা না মেনে অবৈধ ভাবে ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে ও মোহনগঞ্জ-ধর্মপাশা সড়কে কংস নদীর ব্রীজ সংলগ্ন সামাইকোনা গ্রামে মোহনগঞ্জ পৌর এলাকার মৃত রাধাচরন রায়ের ছেলে বিপ্লব রায় নদী ভরাট করে ‘ডি সি এস’ ইটভাটা স্থাপন করে রমরমা ইটের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ফলে একদিকে নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে অন্যদিকে পরিবেশ ও জলবায়ু দূষনের ফলে জনস্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম জানান, বসত বাড়ির পাশে ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধুয়ায় আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছি। গাছের ফল-ফলাদিও কমে গেছে। আবার নদী ভরাট করে যেভাবে দখল করা হচ্ছে তাতে নদী নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও সামাইকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন “এ কিউ সি” ইটভাটা স্থাপন করে ব্যবসা করে যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার দশধরী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরীর ছেলে আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী।২০০০ সালে ইটভাটা লাইসেন্স গ্রহণ করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন করলেও ইটভাটা সংলগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় জনৈক তালেব আলীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তের পর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র না দেওয়ায় জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না মর্মে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেওয়ার পরও ইটভাটার কার্যক্রম অবৈধভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
ইট ভাটার মালিক আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী জানান, ইট ভাটা চালাতে স্থানীয় এমপি রেবেকা মমিন আমাকে মৌখিকভাবে অনুমতি দিয়েছে। সামাইকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান জানান, ১৯৮৭ সালে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়ে বর্তমানে ২৪৮ জন শিক্ষার্থী পাঠদান করছে। ইট ভাটাটি স্কুল সংলগ্ন হওয়ায় ভাটার কালো ধুয়া ও কালিতে কোমলমতি শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বসবাসকারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। জনৈক আবু তালেবের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তের পর জেলা প্রশাসন থেকে ইট ভাটার মালিককে লিখিতভাবে ভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপরও অদৃশ্য শক্তির বলে ইট ভাটার কার্যক্রম চলছে।
সামাইকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ডা: আব্দুল হান্নান জানান, ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধুয়ার কারণে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বসবাসকারীরা প্রায় সর্দি কাশি এবং শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কেন্দুয়া উপজেলায় অবস্থিত এবিএম, এএসটি, সনি ও এপেক্স ইট ভাটা কোন ধরণের কাগজপত্র ছাড়াই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে এবিএম ও এএসটি ব্রিকস্-এর মালিক মোঃ সালাহ উদ্দিন, মদন উপজেলার তুষার ব্রিকস এর মালিক পলাশুজ্জামান খানের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, অন্যান্য অবৈধ ইট ভাটা যে ভাবে চালাচ্ছে, আমরাও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সেভাবেই ইট ভাটা চালাচ্ছি। কিন্তু পলাশুজ্জামান খান আরো বলেন, একটি ইট ভাটা চালাতে যে সকল কাগজ পত্রের প্রয়োজন, আমার সব কাগজপত্র আছে। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় যে, গত ১৪-০১-২০২১ইং তারিখে নেত্রকোনা ডিসি অফিসে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন। পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তিনি আরো ১টি আবেদন করেছেন, যার তারিখ ০৫-১০-২০২০, যার অনলাইন ফাইল নাম্বার ১১১৪৯৮।
নেত্রকোনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাবিকুন্নাহার জানান, নেত্রকোনা জেলায় ২৪টি ইট ভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাকী ৩৬টি ইট ভাটার কোন পরিবেশের ছাড়পত্র নেই। জনবল সংকটের কারণে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমাদেরকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। তারপরও পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া যে সব ইটভাটার কার্যক্রম চলছে। তাদের ব্যপারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তুষার ব্রিকস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে ২ বছর আগের, তিনি নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন। ইট ভাটটি আমি পরিদর্শন করেছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মদন, নেত্রকোনা বুলবুল আহমেদ বলেন, আগামী ২৪ তারিখ থেকে আমাদের অভিযান শুরু হবে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, প্রত্যেক অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে ও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নিচ্ছি এবং সিলগাল করে দেওয়া হচ্ছে।