কামাল উদ্দিন টগর, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি: নওগাঁয় ‘সেক্স ফেরোমন’ ফাঁদ ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সবজি ক্ষেতে একদিকে কমছে কীটনাশকের ব্যবহার, অন্যদিকে দিকে উৎপাদিত হচ্ছে
স্বাস্থ্যসম্মত কীটনাশক মুক্ত সবজি। এতে কম খরচে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি।
এ পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলার কৃষি বিভাগ।
নওগাঁর সবজির ক্ষেতগুলোতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে বসানো হয়েছে প্লাস্টিকের কৌটায় ফেরোমন ফাঁদ (ট্র্যাপ পদ্ধতি)। ঝুলানো এসব ফাঁদের কৌটায় কম খরচে মেশানো হয় বিভিন্ন জাতের ক্ষতিকর স্ত্রী পোকার ঘ্রান সমৃদ্ধ ঔষধ। এতে ছুটে
এসে ফাঁদের পানিতে পড়ে মারা পড়ছে ক্ষতিকর পুরুষ পোকা। এ পদ্ধতিতে ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকা দমন হওয়ায়, বাড়তি খরচ করে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে না কৃষকদের। চলতি বছর ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহারে লাভবান হয়েছেন অনেক সবজি চাষী।
ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়ায় বিষমুক্ত বেগুন, শসা, করলা, চিচিংগা, বরবটি, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি বিষমুক্তভাবে উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে ফেরোমন ফাঁদ। একদিকে কীটনাশকের ব্যয় কম ও অন্যদিকে উৎপাদিত বজি স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় ন্যায্য দাম পাওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
নওগাঁ সদর উপজেলার বর্ষাইল ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক রুহুল আমিন বলেন, হামার ৫বিঘা জমিত কয়েক রকমের সবজির আবাদ করছি। বেগুন, শসা, করলা, চিচিংগা, বরবটি আর চাল কুমড়া। কৃষি অফিসের স্যারেকেরে পরামর্শে এই প্রথম ফেরোমন পদ্ধতিত সবজি চাষে হামার বিঘাপ্রতি দেড় হাজার টেকার ওষধ খরচ হচ্ছে।
এর আগে কীটনাশক দিয়া বিঘাপ্রতি খরচ পড়িচ্ছিলো ৫ থেকে ৭ হাজার টেকা। এতে করিয়া হামার উৎপাদন খরচ বাড়া যাচ্ছিল। এখন হামার খরচ মেলা কম হচ্ছে। আর বিষমুক্ত টাটকা সবজি পাচ্ছি।
একই এলাকার বর্ষাইল গ্রামের কৃষক রমজান আলীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, হামার দুই বিঘা জমিত বেগুন আর মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করিছি। আগে কীটনাশক দিয়া সবজির আবাদে ৫ থ্যাকা ৬হাজার টেকা করা খরচ হচ্ছিল। এখন ফেরোমন পদ্ধতির ফাঁদ ব্যবহার করা মেলা খরচ কুমা গেছে। এতে করা হামি ফ্রেস সবজি বাজারোত বিক্রি করবার পারিচ্ছি। সাথে দামও ভালো পাচ্ছি।
স্থানীয় আমজাদ আলী নামের কৃষক জানান, হামি তিন বিঘা জমিত সবজির আবাদ করিছি। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা বিষমুক্ত সবজি পাচ্ছি। ফেরোমন ফাঁদের জনন্নি একটা প্লাস্টিকের কৌটা, বাঁশের খুঁটি, ফেরোমন লিউর, সাবান বা হুইল পাউডার
ও পানি লাগে সব মিলা প্রতিডা ফেরোমন ফাঁদের জন্নি ১০০ টেকার মত খরচ হয়। এক বিঘা জমিত ৮টা বা ১০ ফেরোমন ফাঁদ করা হয়। পোকারা আসা কৌটার ভিতর পড়া মরা যায়। যার কারনে সবজির ক্ষতি করবার পারোনা। এই পদ্ধতি ব্যবহার করা একদম বিষমুক্ত সবজি হামরা পাচ্ছি। সেই সবজি নিজেরা খাই এবং বাজারে পাইকারি হিসেবে বিক্রি করবার পারি। আর বাজারে বিষমুক্ত সবজির কদরও বেশি। তাই ভালো দামও পাই হামরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি নওগাঁর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ শামছুল ওয়াদুদ এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘সেক্স ফেরোমন’ ফাঁদে ১০০টাকার মত খরচ হয়। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ তৈরির জন্য ফেরোমন লিউর, প্লাষ্টিক কৌটা, তার, সাবান গুড়া, পানি এবং বাঁশের খুটি লাগে। প্লাষ্টিক বৈয়ামের ত্রিকোনাকার ভাবে কাটা অংশের মাঝ বরাবর তার দিয়ে ফেরোমন লিউর বা টোপটি ঝুলিয়ে দিতে হবে। ফেরোমন ফাঁদটি দুটি খুটির সাহায্যে শক্তভাবে বেধেঁ দিতে হয়। তবে যেহেতু ক্ষতিকর
পোকা ফল ও ডগা ছিদ্র করে সেজন্য ফুল ও ডগার কাছাকাছি বক্সটিকে রাখতে হবে। বক্সটির বা কৌটার ভিতরে কর্তিত অংশ( ২-৩ সে.মি.) পর্যন্ত গুড়া সাবান বা হুইল জাতীয় পাউডার মিশ্রিত পানি দিতে হবে। কৌটার অংশ উত্তর – দক্ষিন মুখ করে
ঝুলাতে হবে। এছাড়া ফেরোমন লিউর বা টোপটি যাতে সাবানের পানিতে না ভিজে যায় সেজন্য পানির কিছুটা উপরে রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে ফেরোমিন ফাঁদসহ জৈব বালাইনাশক বিভিন্ন পদ্ধতি জেলার কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। এরই আলোকে বেশকিছু প্রকল্পের আওতায় ‘সেক্স ফেরোমন’ ফাঁদ ব্যবহারে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এতে করে কৃষকরা এই পদ্ধতি ব্যবহারে সুফল পাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব, উৎপাদন খরচ কম হওয়াসহ নানাবিদ সুবিধার কারনে এসব পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। জেলায় ১৩হাজার হেক্টর জমিতে সবজির চাষ হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে জেলার প্রায় ১৪০বিঘা জমিতে ‘সেক্স ফেরোমন’ ফাঁদ ব্যবহার করছে কৃষকরা। আগামীতে এ পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষি
বিভাগ।