কামাল উদ্দিন টগর, নওগাঁ প্রতিনিধিঃ দীর্ঘদিন সংস্কার না করা ও সঠিক নজরদারির অভাবে নওগাঁয় উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের থাকার জন্য সরকারীভাবে বরাদ্দকৃত ৯৮টি এসএএও কোয়ার্টার বেদখল হতে শুরু করেছে। আনুমানিক ষাটের দশকে নির্মিত এসব কোয়ার্টার দীর্ঘদিন অযত্নে ফেলেে রাখায় তা স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিচ্ছে। মূল্যবান জমিগুলো দখলে নিয়ে সেখানে নতুন করে দোকানপাট ও বসতবাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সুদ ব্যবসা, জুয়া, মাদক ব্যবসা ও মাদকসেবনসহ নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে এসব কোয়ার্টারে। দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় বিষয়টি দেখেও দেখছেন না কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। এতে সরকারের কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, আনুমানিক ষাটের দশকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলে বীজ সংরক্ষণ ও বিপননের জন্য সীড স্টোর হিসেবে এই কোয়ার্টারগুলো নির্মান করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে বর্তমান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সৃষ্টি হয়। সেই সময় সারাদেশে খাদ্যশষ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তিগত সহযোগীতা দিতে সীড স্টোরগুলো সংস্কারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের থাকার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। যার নাম দেয়া হয়েছে এসএএও কোয়ার্টার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের জেলার ১১টি উপজেলার ৯৯টি ইউনিয়নে অবস্থিত ৯৯টি এসএএও কোয়ার্টার কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর কর্তৃক সংস্কারের মাধ্যমে বসবাস উপযোগী করে ১৯৮জন উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে কয়েক বছর আগে মান্দা উপজেলার বিষ্ণপুর ইউনিয়নের এসএএও কোয়র্টার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অবশিষ্ট ৯৮টি কোয়ার্টারের মধ্যে বর্তমানে জেলার সদর উপজেলায় ১৫টি, রাণীনগরে ৮টি, আত্রাইয়ে ৮টি, বদলগাছীতে ৮টি, মহাদেবপুরে ১০টি, পত্নীতলায় ১০টি, ধামইরহাটে ৭টি, সাপাহারে ৫টি, পোরশায় ৫টি, মান্দায় ১৪টি ও নিয়ামতপুরে ৮টি রয়েছে। জেলায় ৯৮টি এসএএও কোয়ার্টার থাকলেও এর মধ্যে বসবাসের উপযোগী ৩টি উপজেলার ৭টি এসএএও কোয়ার্টার রয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, জেলার ৯৮টি এসএএও কোয়ার্টারের মধ্যে যেগুলো মূল বাজার সংলগ্ন মূল্যবান সম্পত্তি তার অধিকাংশই প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছে। অনেক কোয়ার্টার দখল করে ভবনের তালা ভেঙে নিজেদের তালা লাগিয়ে টানানো হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের সাইনবোর্ড। অনেক জায়গায় পরিত্যক্ত কোয়ার্টার ভেঙে চারিদিকে দেয়াল তুলে নিজের সম্পত্তি বলে দখল করা হয়েছে। বিভিন্ন এসএএও কোয়ার্টারের মূল্যবান সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করে সেখানে দোকান ঘর নির্মান করা হয়েছে। সেখান থেকে নিয়মিত ভাড়া আদায় করেন প্রভাবশালীরা। দোকানগুলো ভাড়া নিতে জামানত হিসেবে নেওয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সখ্যতা থাকার সুবাদে বেশ কিছু কোয়ার্টার দখলে নিয়েছে বখাটেরা। ঝুঁকিপূর্ণ কোয়ার্টার দখলে নিয়ে কোথাও আবার নিয়মিত বসে মাদকসেবীদের আড্ডা।
কোয়ার্টারে আধুনিক ওয়াফাই সুবিধা, টিভি, চেয়ার, টেবিলসহ অসংখ্য আসবাবপত্র দিয়ে সেখানে রাতভর আড্ডাবাজি, নিয়মিত মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা ও সুদ ব্যবসা করা হয়। কোয়ার্টারে আড্ডারত বখাটেদের উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসীরা। এসব কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে যাবার পথে যৌন হয়রানি ও ইভটিজিং এর স্বীকার হতে হয় অনেককেই। কিছু কিছু কোয়ার্টারগুলোতে বখাটেদের টর্চার সেলও তৈরী রয়েছে। এসএএও কোয়ার্টারের কক্ষে মাদক সেবন, জুয়াসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ করা হয় প্রতিনিয়নত। কোয়ার্টারের ঘরগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় মাদকসেবীদের আলামত। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে তাদের সখ্যতা থাকায় ইউনিয়নে কর্মরত উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ভয়ে তাদের কিছু বলতেও পারেন না।
ইউপি চেয়ারম্যানসহ কৃষি বিভাগকে লিখিত অভিযোগ দিয়েও জায়গাগুলো দখলমুক্ত করতে পারছে না উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।
নওগাঁ শহরের গোস্তহাটির মোড়ে এসএএও কোয়ার্টারের সম্পত্তিতে মুদি দোকান নির্মান করেছেন নাইম হোসেন। তিনি বলেন, এখানে পৌর মেয়র কিছু জমি দখলে নিয়ে তার বহুতল ভবনে যাবার রাস্তা তৈরী করেছেন। ইজি বাইক চালকরা তাদের সংগঠনের একটি অফিস করেছে। কোয়ার্টারের মূল ভবন পুরোটাই বাংলাদেশ প্রাক্তন সেনা সংস্থার সাইনবোর্ড টানিয়ে দখল করে রেখেছে। তাই ভাবলাম আমিও একটা দোকান করি।
নওগাঁ শহরের গোস্তহাটির মোড়ে এসএএও কোয়ার্টারের মূল ভবন দখলকারী বাংলাদেশ প্রাক্তন সেনা সংস্থা নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি অবঃ সার্জেন্ট ইনতাজুল হক মোল্লা বলেন, আমাদের সংগঠনের স্থায়ী কোন কার্যালয় না থাকায় প্রায় ১০ বছর আগে ভবন দখলে নিয়ে এখানে অস্থায়ীভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। আগে সংগঠনের খরচ চালাতে কিছু দোকানপাট এখানে ভাড়া দিতাম। এখন আর দেয়া হয় না। বিষয়টি নিয়ে কৃষি বিভাগ বাদী হলে একাধিকবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আলোচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে কখনো এই ভবনটি ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলা হলে আমরা দখল ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো।
শহরের গোস্তহাটির মোড়ে এসএএও কোয়ার্টারের সম্পত্তিতে দোকানঘর নির্মাণ করে আসবাবপত্র রেখেছেন নওগাঁ পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নজমুল হক সনি। তিনি বলেন, আমার বাড়ির সামনের কোয়ার্টারের জমিতে যেসব দোকানঘর রয়েছে তা আমার নয়। আপনারা এসব খবর আওয়ামীলীগের পার্টি অফিস থেকে নিয়ে এসেছেন। আর কোন খবর পান না? আপনি কিসের সাংবাদিক? এ বিষয়ে কিছু জানতে হলে আমার সাথে দেখা করেন।
সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহীনুর রহমান বলেন, চন্ডিপুর ইউনিয়ন এসএএও কোয়ার্টার একেবারেই বোর্ড বাজার সংলগ্ন। তাই এই জমির বর্তমান মূল্য অনেক বেশি। শামসুর রহমান বাচ্চু, সুমনসহ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীরা এই কোয়ার্টার ভেঙে ৭টি দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। প্রত্যেক দোকানঘর থেকে অগ্রীম জামানত বাবদ ৩০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক ভাড়া আদায় করা হয়।
চন্ডিপুর ইউনিয়ন এসএএও কোয়ার্টার দখল করে ৭টি দোকানঘর নির্মাণকারী সুমন হোসেন বলেন, দাদাদের আমলে জমিটি সীড স্টোর তৈরী করতে দান করা হয়েছিল। তবে ওই সময় আমাদের ২ জন দাদা বাদী হয়েছিলেন। জমিটি খতিয়ানমূলে আমার বাবার নামে থাকায় এখন আমরা ভাইয়েরা মালিক। তাই এটা দখল করে ভেঙে কিছু দোকানপাট তৈরী করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। কৃষি বিভাগ চাইলেও আমরা এই জমির দখল ছাড়বো না।
সদর উপজেলার কির্তীপুর ইউনিয়নে কর্মরত উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র বলেন, ৩ বছর আগে থেকে আমাদের কোয়ার্টার বখাটেরা দখল করে রেখেছে। সেখানে টিভি, ওয়াইফাই সংযোগ, একাধিক চেয়ার টেবিল রেখে রাতভর আড্ডাবাজি, নিয়মিত সুদ ব্যবসা, মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসা করে তারা। বখাটেদের উৎপাতে আশেপাশের বাড়িগুলোতে থাকা মা-বোনেরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছে। ৩ বছর আগে তৎকালীন উপজেলা কৃষি অফিসারসহ সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক বরাবর অভিযোগ করেও প্রতিকার মেলেনি। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকায় ওই বখাটেদের সামনাসামনি কিছু বলার সাহস আমরা পাই না। জায়াগাটা মূল বাজার সংলগ্ন হওয়ায় বখাটেরা সেটি কোনভাবেই ছাড়তে চাচ্ছে না।
জেলার একাধিক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তরা জানান, প্রতি বছর বেহাত-বেদখল সংক্রান্ত প্রতিবেদন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। যেগুলো দখল হয়ে আছে তার বেশিরভাগ গুলোই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে থাকা প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে রেখেছেন। তাদেরকে উচ্ছেদ করলে আবারো তারা কিছুদিন পর পর কোয়ার্টার দখলে নেয়। সরকারী এই মূল্যবান সম্পত্তি রক্ষার্থে বহুবার সীমানা প্রাচীর নির্মানের জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাড়া মিলেনি।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) একেএম মনজুরে মাওলা সাংবাদিককে বলেন, বসবাস অনুপযোগী হওয়ায় আমাদের এসএএও কোয়ার্টারগুলোতে এখন আর থাকা যায় না। যতই দিন যাচ্ছে কোয়ার্টারের জমির মূল্য বাড়ছে। এসব জমির উপর নজর পড়ছে প্রভাবশালীদের। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সেই দলের নেতারা জমিগুলো হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো আমাদেরকেই মামলা-হামলার স্বীকার হতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ উইং) শামছুল হক বলেন, সারাদেশে বেদখল হওয়া এবং দখলমুক্ত এতো বেশি সংখ্যক এসএএও কোয়ার্টারের সীমানা প্রাচীর রাজস্ব থেকে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কৃষি বিভাগের এই সম্পদ রক্ষার স্বার্থে সীমানা প্রাচীর নির্মাণে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।