তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : বঞ্চনা আর অবহেলায় যাদের জীবন গড়া। অধিকারহারা অবহেলিত চা শ্রমিকদের রয়েছে করুণ ইতিহাস। দেশে প্রায় ২০০ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন আমাদের চা শ্রমিকরা। তাদের নিপুণ হাতে তোলা পাতাকুঁড়ি দিয়েই আমরা ক্লান্তি দূর করতে তৃপ্তির সঙ্গে পান করি গরম চা। তাদের শ্রমেই বড় হয়ে ওঠেন বাবু, সাহেব ও মালিকপক্ষ।
শ্রমিকরা জানান, চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। পাতাকুঁড়ির সঙ্গে জীবনের চাকা ঘুরলেও সংসারের চাকা মাঝে মাঝে আটকে যায়। প্রতিদিন ১২০ টাকা মজুরি পেয়ে আর চলতে পারছি না। ঘাম ঝড়ানো শ্রম দিয়ে চা উৎপাদন বাড়ালেও দৈন্যতা যাচ্ছে না আমাদের। সুপড়ি (বাঁশ-বেতের তৈরি ছাতা) আর গামছা (চা পাতা তুলে রাখার তলে) নিয়ে সকালে বের হই আর বিকেলে ফিরি।
বাগান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সব পণ্যর দাম বাড়লেও বাজারে দিন দিন চায়ের মূল্য হ্রাস পাচ্ছে এতে বাগান পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো বাগান ভর্তুকি দিয়ে চালানো হচ্ছে। দেশের অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকদের সঙ্গে চা-শ্রমিকদের তুলনা করলে তাদের মজুরি তেমন কম নয়। তাদের বোনাস, রেশন ও ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বাড়িভাড়াও নেই। বাগান মালিক পক্ষ সাধ্যমতো শ্রমিকদের মূল্যায়ন করছে। ডানকান কোম্পানির মালিকানাধীন মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার করিমপুর চা বাগানে কথা হয় নারী চা শ্রমিক মজিদুন, লঙ্ক্ষীমনি গোয়ালা, মায়া রানী করসহ অনেকের সঙ্গে।
তারা বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। কিন্তু তাদের মজুরি সে অনুপাতে বাড়ছে না। ১২০ টাকা মজুরি নিয়ে টানাপোড়েনের জীবন কাটাতে হচ্ছে চা শ্রমিকদের। কথা হয় চা শ্রমিক নেতা বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর রায়, কাজল রায় ও পঞ্চায়েত সভাপতি গণেশ বড় কুরমির সঙ্গে। তারা অভিযোগ করে ডিজিটাল বাংলা নিউজকে বলেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন চুক্তি হয় কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের চুক্তি মোতাবেক দাবি পূরণ করেনি। দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়।
কথা হয় বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের প্রধান উপদেষ্টা রাম ভজন কৈরীর সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদক’কে বলেন, চা শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে সচেতন না থাকায় তারা বঞ্চিত। চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরি ও রপ্তানি পণ্য। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। এই চা উৎপাদনে নিরলসভাবে কাজ করছে দেশের ১৬৭টি বাগানের প্রায় তিন লাখ চা শ্রমিক। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯২টি চা বাগানে কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক। তারা বছরের পর বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখনও তাদের বেতনবৈষম্যসহ নানা বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।
রাজনগর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. মহসীন বলেন, মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণে আন্তরিক। বিশ্ববাজারে চায়ের দাম কমে যাওয়ায় বাগান পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজড়া বলেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলেও অনেক বাগান সম কাজ সম মজুরি দিচ্ছে না।
বাগান ব্যবস্থাপক টি প্লান্টার ইবাদুল ইসলাম ও মৌলভীবাজারের চানভাগ চা বাগানের ব্যবস্থাপক লংলাভ্যালীর সার্কেল চেয়ারম্যান মো. মুজিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে চায়ের দরপতনের কারণে বাগান পরিচালনায় আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
তাছাড়া দেশের অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকদের সঙ্গে চা-শ্রমিকদের তুলনা করলে তাদের মজুরি তেমন কম নয়। বাজারে নিম্নমানের চা পাতার প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। চা নিলামে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হলে চায়ের মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে আগামীতে বাগান চালানো কঠিন হবে।