কুমিল্লা জেলা মুরাদনগর উপজেলার ১৪ নং নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড পূর্ব নগরপাড় গ্রামের কৃতি সন্তান মৃত হাজী নায়েব আলীর ছেলে আমেরিকান প্রবাসী এবং রেমিটেন্স যোদ্ধা মোহাম্মদ ইসলাম দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চান।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা যে কয়টি খাতের ওপর নির্ভরশীল তার মধ্যে অন্যতম রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। সরকারী হিসেবে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশী কর্মী আছেন ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি। যাদের ঘাম ও শ্রমে উপার্জিত অর্থ দেশে এলেই তাকে আমরা প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বলে থাকি। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রমাণ হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীর সময়। করোনার পরপরই শুরু হওয়া বর্তমান বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কটেও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই বাংলাদেশের বড় সম্বল।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পর, বিশ্বব্যাপী দেউলিয়া আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়েও যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাতেও আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে এই রেমিটেন্স।
বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ট্রাস্ট ফান্ড দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি জানিয়েছে, সব আশঙ্কা দূর করে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (১ ডলার = ৮৪ টাকা) রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় পেয়েছে। এর ফলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ ২০১৯ সাল থেকে এক ধাপ এগিয়ে ২০২০ সালে সপ্তম স্থানে উঠে আসে। কিন্তু তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের সব সমস্যার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তাদের ভোগান্তির শুরু হয় ঘর থেকে। রেমিটেন্স যোদ্ধাদের বেশির ভাগ গ্রামের অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ। দালালরা প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা গোপন করে উচ্চ বেতন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাজের জায়গা, বিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশ পাঠানোর ফাঁদে ফেলে তাদের। তারপর পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ডাক্তারি পরীক্ষা, ভিসা, ইমিগ্রেশন, স্মার্টকার্ড এবং বিমান ভাড়া ইত্যাদির কথা বলে হাতিয়ে নেয় প্রয়োজনের কয়েকগুণ টাকা। সহজ-সরল মানুষগুলো প্রবাসে গিয়ে দুর্দিন পার করে।
দেশে মাত্র দুটি ব্যাংক প্রবাসীদের বিদেশ যেতে ঋণ দেয়- রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী ও বেসরকারী প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। তাদের প্রদানকৃত ঋণও প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর খরচও তুলনামূলক অন্যদেশের থেকে বেশি।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এক জরিপ শেষে বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বলে তথ্য প্রকাশ করে। সংস্থাটির মতে, পুরুষ কর্মীর ক্ষেত্রে তা ৭ লাখ টাকা এবং মহিলা কর্মীর ক্ষেত্রে তা ৯৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা মাইগ্রেশন ডেটা পোর্টাল ২০১৭ সালের উপাত্তের ভিত্তিতে জানিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে একজন ভারতীয় শ্রমিকের কাজ পেতে খরচ হয় ১ হাজার ১৫৬ ডলার বা ১ লাখ টাকা, যা সে দুই মাসে আয় করতে পারে। একজন নেপালী খরচ করে ১ হাজার ৮৮ ডলার বা ৯৫ হাজার টাকা, যা তিন মাসের আয়। সবচেয়ে কম খরচ হয় ফিলিপিন্সের শ্রমিকের, যার অঙ্ক মাত্র ৪১৪ ডলার বা ৩৬ হাজার টাকা, যা তারা এক মাসেই আয় করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমিক ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করে কাতারে যান এবং ১৫-২০-২৫ হাজার টাকার নিম্নবেতনেই কাজে নেমে পড়েন। এত অভিবাসন ব্যয়ের সমপরিমাণ টাকা আয় করতে তার বছরের পর বছর সময় লাগে।
অনেক সময় বিদেশের কর্মস্থলে অমানবিক অবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশী শ্রমিক-কর্মীকে বাধ্য হয়েই দাসের জীবন কাটাতে হয়। কারণ, বিপুল অর্থ খরচ করে তাকে প্রবাসে যেতে হয়েছে। যা তিনি জমি বেচে অথবা এনজিওর উচ্চ সুদে ঋণ করে সংগ্রহ করেছেন। সরকারের যথাযথ নজরদারি ও অবহেলার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের ওপর নিভর্রশীল। বাধ্য হয়ে বিদেশগামীরাও এসব মধ্যস্বত্বভোগীর ওপর নির্ভরশীল। এই অবস্থার জরুরী অবসান প্রয়োজন।
প্রবাসীদের ভোগান্তি দূর করতে প্রবাসজীবনের শুরু থেকেই কাজ করতে হবে। প্রবাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দালালের ফাঁদে না পড়েন। মানব পাচারকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্মূলে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের শ্রমশক্তি দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কর্মসূচী নিতে হবে। তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে।
রেমিটেন্সের প্রবাহ ঠিক রাখতে দক্ষদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিমানবন্দরের আসা-যাওয়ায় চরম ভোগান্তি দূর করতে হবে। প্রবাসীদের যাতায়াতের জন্য দেশের বিমানবন্দরসমূূহে পৃথক চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারাই আমাদের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কমাতে হবে অভিবাসন ব্যয়। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় অভিবাসন হলে ব্যয়ের বিষয়টি বিদেশে গমনেচ্ছুক ব্যক্তির স্বার্থে করতে হবে। প্রবাসে তাদের দুর্ভোগ নিরসনে আগামী পাঁচ বছরে ১০ হাজারের উর্ধে প্রবাসী-অধ্যুষিত দেশে প্রবাসী উইং প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দূতাবাস ও মিশনগুলোর স্বদেশী ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সেবা দিতে হবে।
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি