কুমিল্লার নানুয়া দীঘির একটি পূজামণ্ডপের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের মন্দির-মন্ডপ ও ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, মারধর-নির্যাতনের যে তান্ডব ঘটে গেল তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কুমিল্লার সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিলে নানুয়া দীঘির পূজামণ্ডপের ঘটনাটি এত দূর গড়াত না।
ঘটনার পরপরই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রশাসনের কাছে পূজামণ্ডপগুলোতে দ্রুত পুলিশ পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ গেছে অনেক পরে। অনেক পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। ওই পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখে অবমাননার যে ভিডিওটি প্রথম ভাইরাল হলো সেখানে দেখা গেছে পুলিশের ওসি কোরআন নিয়ে হাঁটছেন এবং বলছেন যে, ‘ঘটনাটি সত্যি’।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে যে, ওই পুলিশ কর্মকর্তা কেন এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে লাইভ ভিডিও প্রচার বা ভিডিও ধারণ করতে দিলেন? কেন তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে মন্ডপটি নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে সেখানে সাধারণের প্রবেশ আটকাতে পারলেন না? এটি কি পুলিশের পেশাদারিত্ব ও সক্ষমতার অভাব নাকি দায়িত্বপালনে গাফিলতি? এ বিষয়ে অবশ্যই পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহি প্রয়োজন। একই কথা প্রযোজ্য কুমিল্লার ঘটনার জেরে দেশের অন্যান্য স্থানে হামলা ও সহিংসতা ঠেকাতে না পারার বিষয়েও।
লক্ষ করা জরুরি, নানুয়া দীঘির ঘটনাটি ঘটে বুধবার সকালে। পরদিন বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূজামণ্ডপে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে কেউ সাহস না পায়।’ দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রকাশ করেছে।
দেশের মানুষও আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ় অবস্থানের কারণে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থেকে দুর্গাপূজার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু দেখা গেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বার্তা ছড়িয়ে পড়ল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির-মন্ডপ এবং হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও মারাত্মক হামলার ঘটনা ঘটল। সংবাদ মাধ্যমের নানা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অন্তত ১০টি জেলায় ২২টি মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
এ সময় বুধবার বিকেল থেকে কুমিল্লায়, বৃহস্পতিবার দিন আরও পাঁচটি জেলায় এবং মধ্যরাতের পর থেকে শুক্রবার বিকেল-সন্ধ্যানাগাদ সারা দেশেই দীর্ঘ সময়ের জন্য মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ রাখা হয়। হামলা-সহিংসতা ঠেকানোর কৌশল হিসেবে এই পদক্ষেপ কতটা কার্যকর কিংবা যৌক্তিক তা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক হতেই পারে। এতকিছুর পরও কেন এই বিপর্যয় ঠেকানো গেল না তার উত্তর মিলবে কি?
নানুয়া দীঘির উসকানির আগুন সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিকে সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা জরুরি। কেননা, এরকম ঘটনা দেশে এই প্রথম নয়। বরং সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ধারাবাহিকভাবেই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিজয়ের পর দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর বড় ধরনের হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ বিষয়ে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল। সেই কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, তা এখনো ফাইলবন্দিই রয়ে গেছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান তিন মেয়াদে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া ও গোবিন্দগঞ্জে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ওপর যেসব হামলা হয়েছে, সেসব মামলারও বিচারও হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও শাস্তি পায়নি। উপরন্তু উপরোক্ত বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-সহিংসতার যে দৃষ্টান্তের কথা বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বরাবরই বলে থাকেন এখন তারা নিজেরা আর সেই দায় এড়াতে পারবেন কি না? উপরন্তু আরও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল কিংবা শহরাঞ্চলেও হাজারো মানুষকে কীভাবে এতটা উন্মত্ত করে তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-সহিংসতায় যুক্ত করা যাচ্ছে? দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ কীভাবে এমন ধর্মান্ধ হয়ে উঠছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি।
অবশ্য, দেশের রাজনীতিতে দশকের পর দশক ধরে ধর্মকে যেভাবে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আর একের পর এক ঘটনায় ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী যেভাবে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে তাতে সমাজে এমন ধর্মীয় উন্মাদনা বিস্তারের কারণ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না।
বর্তমান বাস্তবতায় এটা স্পষ্ট যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় বিবেচনার যে একচক্ষু দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটা দূর করা না গেলে কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী অপশক্তির চক্রান্ত প্রতিহত করা সম্ভব নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ দেশের সব রাজনৈতিক দলেরই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করা জরুরি।