ছোট গল্প – কলমে শ্যামাঃ শুনেছি ভাসা ভাসা শব্দতরঙ্গের মত। কিন্তু কখনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি জান্নাতি পাপিয়ার সৌন্দর্য! বলতে গেলে আমার কল্পনার সীমাবদ্ধতার জন্য, আঁকতে পারিনি জান্নাতি পাপিয়ার সুবাস, নিঃশ্বাসের সুগভীর প্রকাশযোগ্য কোন অনুভূতির চাদরে শীতের কুয়াশা ভেদ করে একটু শিশির বিন্দু স্পর্শ করার মত।
অথচ সৌভাগ্য নাকি পায়ে হেটে আসে, আমার জীবনের সাঁঝেরবাতি মিটমিটিয়ে জ্বলছে, এমন সময় জান্নাতি পাপিয়ার কাছে থেকে এতটা সমাদর, আপ্যায়ন আর এতটা সন্মান পাব। এ জীবনে সবই যেন কল্পনাতিত আর অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
আমার অনুভূতির এমনটাই ক্ষুদ্র প্রকাশ মাত্র, যেন উত্তাল সাগরের ঢেউয়ে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসছি! ২৪ ঘন্টার কাটা পার হয়নি, তবুও আমার মন বলছে আমি কি জান্নাতি মানুষ দেখে এলাম নাকি ঐ মানুষ গুলো ছোট বাগান বাড়িটায় জান্নাতের টুকরা করে তুলেছে। আপন মমতায় জড়িয়ে পবিত্র ভালোবাসার বন্ধনে। এই জগৎ এর, এ জান্নাত পরকালের জান্নাতের সমতুল্য সুন্দর হবে, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি। বিন্দু মাত্র দ্বিধা নেই আমার। অন্তত আমাকে যদি জান্নাত নির্বাচন করতে বলা হয় নিঃসংকোচে আমি জান্নাত সমতুল্য ছোট্ট ঐ বাগান বাড়িটার দিকেই কেবল হাত বাড়াব জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে।
খোদার দ্বারে শুকরিয়া আদায় করে জানিয়ে দিবো হে পরমকরুনায়, পরকালের জান্নাত তোমার এই গুনাগার বান্দার জন্য এই দুনিয়াতে দেখার সৌভাগ্য দিলে। আর আমাকে শুধু এই জগৎ এর এই জান্নাতের সুবাস থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না। এতটুকু সুবাস পেতে দিলেই আমি তোমার দুনিয়া আর পরকালের সব জান্নাত, বেহেস্তকে হৃদয়ঙ্গম করবো অবলীলায়।
হ্যাঁ আজ আমি আপনাদের এমন একটি জান্নাতি পাপিয়ার পরিবারের গল্প শুনাতে চাই!
গতকাল পরন্ত বিকেলে সেই জান্নাতি পাপিয়াদের বেহেস্তি পরিবার দেখার উদ্দেশ্য মেঠোপথ ধরে হাটছিলাম। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দুপাশে ছোট ছোট গ্রামীণ ঘর, অপরুপ পরিবেশ সে এক চোখ জুড়ানো মনোরম প্রকৃতির সৌন্দর্য, সারি সারি ধান ক্ষেতের ঘ্রাণে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসের মূর্ছনায়।
তার মধ্যে হঠাৎ এক অজানা আতংক আর ভয় আমাকে ঘিরে ধরলো, নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল, জানি না জান্নাতি পাপিয়াদের বাড়ির সুন্দর পরিবেশের সাথে সামান্য সময়ের জন্য নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব কিনা। আমাকে তারা কিভাবে গ্রহন করবে জানি না, আমি তো পাপি মানুষ গুনাগার। একটা অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যতটা পথ এগোচ্ছি আমার পা যেন ধরে আসছে, যেন পথ শেষ হয়না।
আরেক দিকে জান্নাতি পাপিয়াদের বাড়ির পথ চিনি না, লোকের মুখে শুনে শুনে এগোচ্ছি। যেন হাজার বছর ধরে পথ হাটিতেছি। একবার তো মনে হলো পিছন ফিরে দৌড়ে পালাই, কিন্তু সে পথও রুদ্রদীপে পরিনত হয়েছে।
কেমন আছো ভাই, পথে আসছে কষ্ট হয়নি তো, হঠাৎ সেই চিরচেনা আদর মাখা, মায়ামমতা মিশানো আপন মানুষের পবিত্র কন্ঠে আমার ঘোর কেটে নিজেকে আবিষ্কার করলাম।
দেখলাম, সেই ছোট বেলায় মায়ের মত বড় বোনের মমতাময়ী মায়ের হাত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ছোট ভাই আর সন্তানের মত করে। ততক্ষণে রাস্তায় আসতে আমার যে ভয়, দ্বিধা দন্ড আর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। সব যেন তাহার পবিত্র হাতের স্পর্শে ভুলে গেলাম। ফিরে যেতে ইচ্ছে করলো এক যুগ আগের বায়না ধরে সরিষা তেল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে অনেক আনন্দের গল্প শুনতে শুনতে মুড়ি খেয়ে সবার করে, আবার মুড়ির বাটি মমতাময়ী বড় বোনের হাতে দিয়ে বলা আপনার হাতের মাখানো মুড়ির স্বাদে পেট ভরে তো মন তো ভরে না, আরও কিছু দিননা। বলেই অট্রহাসিতে সবাই ফেটে পড়া।
আবার হঠাৎ চেতনা ফিরে পেলাম তার দরদী কন্ঠে, কি ব্যপার! বাড়ির বাইরে দাড়িয়ে থাকবে নাকি? এসো এসো বাড়ির ভিতরে এসো।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই জান্নাতি হাওয়ায় সুবাসিত হোল মন আমার। সেই সাথে বাড়ির দক্ষিণে খোলা মাঠ থেকে ভেসে আসছে ফাল্গুনী হাওয়া, বসন্তের প্রথম প্রহরের ঠিক তখন গোধূলির পদধূলিতে মহুয়া বায়ুমন্ডল সুরভিত হয়ে আমার অশান্ত মনে প্রশান্তির ছোঁয়ায় প্রবেশ করলাম দুনিয়ার প্রথম বেহেস্তি পরিবারে আমার নিজের চোখে আর শরীরে।
তারপর যথারীতি জড়তার সাথে কুশল বিনিময় পর সন্মানের সাথে অনেক সুন্দর আপ্যয়ন করলেন, বিশেষ করে তাদের দুই বোনের নিজের হাতে তৈরি কপি, ঠিক যেন অমৃত সুধা। আমার মায়ের হাতের খাবারের পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার খেয়ে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো। শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল পবিত্র হাতের স্পর্শে আর পবিত্র মনের পবিত্রতায় পরম যত্ন তৈরি খাবার জান্নাতি খাবার ছাড়া আর কি হতে পারে।
তারপর, মমতাময়ী মায়ের মত বড় বোন আমার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি ক্ষুদ্র, অযোগ্য আর সামান্য মানুষ কি আর বলব, তিনি সবইতো জানের ছোট বেলায় আব্বা চলে গেলেন ইয়াতিম করে। তারপর কত লোকের কত টিটকারি আর অবহেলা। ধৈর্য ধরে দুঃখী মায়ের দোয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি। সেই সাথে জানতে চাইলাম তাহার পরিবারের সবার বর্তমান অবস্থা।
তিনি বিনয়ের সাথে জানালেন, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছেন। মেয়ে দুটা শিশু থাকতেই আল্লাহ তার কাছে থেকে স্বামীকে নিয়ে গেলেন। তারপর, ফেরেস্তার মত শশুর আব্বা আর তাহার বড় ভাই আমার মেয়েদের নিজের সন্তানের মত লালনপালন করেছেন। নিরাপত্তা দিয়ে পরম যত্নে আগলে রেখেছেন, এটা আমাদের পরম সৌভাগ্যের ব্যপার, সে জন্য খোদার কাছে শুকরিয়া জানাই।
কেমন জানি করে, মেয়ে দুটা তাদের পবিত্র মনের স্পর্শে আমাকে আপন করে নিয়ে আমাকে চিরকৃতজ্ঞ করে রাখল। আমি তাদের কুশল জানার পর, তারা জানালো একজন স্কুলে আর একজন ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারে মাকে সহোযোগিতা করেন। পাশাপাশি বড়জন কলেজের পাশে একটি মা ও শিশু ক্লিনিকে পার্ট টাইম জব করেন শুনে খুব খুশি হলাম।
বলতেই বড়জনের মুখে একটা স্বপ্নের রেখাপাত লক্ষ করলাম। দেখলাম তার চোখে হাজারো স্বপ্ন নয়, মাত্র দু-তিনটা স্বপ্ন। এক- সুন্দর মত পড়াশোনাটা শেষ করার সাথে ভালো মানুষ হয়ে সংসারের হাল ধরে মায়ের মুখে হাসি ফোটানো। দুই- ছোট বোনটাকে সত্যিকারের মানুষ হতে যা যা প্রয়োজন তার সবকিছু সাধ্যমত চেষ্টা করা। তৃতীয়ত – একজন বিশ্বস্ত মানুষের বিশ্বস্ত হাত ধরে সুখেদুখে সাদামাটাভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া। এই জান্নাতি বাড়ির মতই আরও একটি জান্নাতি পাপিয়ার মা হওয়া।
তারপর আমার পরম শ্রদ্ধেয় মায়ের মত বড় বোন তাহার বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখালেন, দেখলাম তার প্রতিবেশীরাও অনেক আন্তরিক যেন সবাই জান্নাতি ফুল বাগানের এক একটা ফুল গাছ আর ছেলে মেয়ে গুলো সৌরভের গোলাপ। একটা সময় এই জান্নাতের বাগান থেকে বের হবার সময় হলো, সবাই সবাইকে সালাম বিনিময়ের পর শেষে একটা ইচ্ছে প্রবলভাবে ঘিরে ধরলো মায়ের মত মমতাময়ী বড় বোনের পদধূলি নিতে। কিন্তু আমার সংকীর্ণ মন সেই সাহস পায়নি।
এক পা বাড়াতেই একটা নিঃপাপ আর পবিত্র চোখ আমাকে পিছনে ফিরে দেখতে বাধ্য করলো। প্রথম বার দেখলাম তার চোখে কত মায়া আর নীলাকাশের দিগন্ত ছোঁয়া এঁকে জগৎ এর সকল রঙ তুলিকে হার মানিয়ে সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন জীবন্ত অপ্সরী। মুখখানি কত যে পবিত্র, যে পবিত্র মুখটা জীবনে একটি পলক দেখলে জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে জেনে গেলাম, হে মহান প্রভু তুমি মানুষকে এতটা সুন্দর আর পবিত্র করে সৃষ্টি করেছেন যে, আমি পাপি গুনাগারের পক্ষে কল্পনাতেও অনুভব করা সম্ভব নয়। এমন হলো যে নিজের অজান্তেই আল্লাহ তায়ালাে পবিত্র পদতলে সিজদাহ্ করে নিলাম।
হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই মেঠোপথের দুপাশে ধান ক্ষেতের মাঝখানে। যেন অজানা কারণে মনটা বিষাদে ভরে গেল, নিজেকে বোঝাতে পারছি না কেন মনটা এমন বিষাদে ভরে গেল। তখন আমার মনটা বলে দিলো তুই বড় স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ মানুষ কি করে ভুলে গেলি সেই দেবতা তুল্য বড় ভাইটা কে। যে কিনা তোর ছোট বেলায় পরম যত্নে আগলে রেখেছিল।
স্কুল থেকে ফেরার সময় যখন তার বাজারের দোকানের সামনে দিয়ে হেটে যেতে দেখলেই পিছন থেকে নিঃশব্দে বুকে টেনে নিয়ে বলত, কিরে পাগলা এই পরন্তু বিকেলে শুকনো মুখে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিস। আমার সাথে আয়, কিছু কিনে দেই খেতে বাড়ি যা। মাঝে মধ্যে লজ্জা লাগত তাই তার কাছে থেকে খাবার কিনে নিতে চাইতাম না। তখন আদরমাখা শাসনের সুরে বলতে চর দিয়ে দাঁত ফেলে দেব কিন্তু রে পাগলা।
সেদিন নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলত আরে পাগলা তুই তো জানিস না, তুই আমার কে। তুই যে আমার সন্তানতুল্য, আজ তো বুঝবি না, যেদিন থাকব না সেদিন তো বুঝতে পারবি, কেন তোকে পাগলা বলে বুকে জড়িয়ে রেখে কপালে চুমু এঁকে দেই! নিজের অজান্তেই অশ্রু তে আমার চোখ ভিজে গেছে খেয়াল করলাম আমি ধান ক্ষেতের পাশে বসে আছি।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সেই আদরমাখা পাগল ডাক নাম টা ধরে আর কেউ ডাকে না আমায়। ভাবতেই আবারও শিশুর মত বুকটা হুহু করে কেদে উঠলো। এক যুগেরও বেশি সময় আগে, এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার মাথার উপরের বটবৃক্ষের ছায়াটা সরে গিয়ে আবারও আমি ইয়াতিম হলাম।
শিশুকালে আব্বা কে হারিয়ে যখন অসহায়ের মত পথে পথে ঘুরছিলাম তখন এই ফেরেস্তার মত মহান মানুষটি আমাকে সন্তানের মত বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আজ তার রেখে যাওয়া জান্নাতে বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখে গেলাম।
হে মহান আল্লাহ তায়ালা আপনার পবিত্র পায়ে সিজদাহ্ করে করজোড়ে অনুরোধ, হাজারো ফরিয়াদ আর আকুল পার্থনা করি, তার জান্নাতের বাগানের সকল মানুষ গুলোকে সমস্ত বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে সুখে শান্তিতে রাখুন। আর আমি তো আপনার গুনাগার পাপি বান্দা। খুব নগন্য আর ক্ষুদ্র মানুষ, যদি এই পবিত্র জান্নাতের বাগানে সামন্য যত্ন আর সেবা করার সৌভাগ্য দেন তো আমার জন্ম সার্থক আর পূর্ণতা পাবে।
– আমিন।
[দুদিন আগে আমার পরম আত্মার আত্মীয় বাড়িতে থেকে ঘুরে এসে স্মৃতিচারণ মূলকথা ]