তিমির বনিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি : বৃহত্তর সিলেটের সমৃদ্ধ বনাঞ্চল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। আন্তর্জাতিক এবং বাংলাদেশের অবস্থায় এই উদ্যানে মহাবিপন্ন, বিপন্ন এবং বিরল অনেক বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল। শুধুমাত্র বন্যপ্রাণীদের জন্য উপকারী এবং কল্যাণমুখী সিদ্ধান্তের অভাবে রেল লাইন এবং পাকা সড়কে পিষ্ট হয়ে অবলীলায় মারা পড়ছে দেশের বন্যপ্রাণী। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈদ্যুতিক তারে ঝুলে লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণীদের মারা যাওয়ার সচিত্র তথ্য।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং সংলগ্ন এলাকায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার জুড়ে বিদ্যুতের খোলা তারের লাইন রয়েছে। এই তারে স্পৃষ্ট হয়ে প্রায়ই বন্যপ্রাণী মারা পড়ছে। এর সবগুলোই গাছে গাছে ঘুরতে গিয়ে উদ্যানের ভেতর ও উদ্যান-সংলগ্ন এলাকার বিদ্যুতের খোলা তারে স্পৃষ্ট হয়ে প্রায়ই আহত হচ্ছে ও নির্মমভাবে মারা পড়ছে।
সূত্র আরও জানায়, গত এক বছরে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও উদ্যান-সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর (Bengal Slow Loris), মুখপোড়া হনুমান (Capped Langur), চশমাপরা হনুমান (Phayer’s Langur) সহ প্রায় অর্ধ ডজন বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু রোধে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে খোলা তারের পরিবর্তে আবরণযুক্ত তার প্রতিস্থাপনের জন্য চিঠি দিয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘চলতি বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একটি চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু হয়। হনুমানটির সঙ্গে ছিল তার ছোট্ট বাচ্চা। বাচ্চাটির বয়স প্রায় তিন-চার দিন হবে। মা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটিও এতিম হয়ে গেল। তারপর সেই হনুমান শাবকটিকে উদ্ধার করে জানকিছড়া রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। এর চারদিন পরে হনুমান শাবকটিও মারা যায়। আবরণজনিত বৈদ্যুতিক তার থাকলে এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যুগুলো ঠেকানো সম্ভব হতো। ’
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছর ২০২১ সালের শুরু থেকে চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট ৭টি মহাবিপন্ন, সংকটাপন্ন, বিপন্ন বন্যপ্রাণী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি লাউয়াছড়া সংলগ্ন ফুলবাড়ি চা-বাগান এলাকায় একটি এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়।
এছাড়াও ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এলাকায় একটি লজ্জাবতী বানার, ১৮ জুন রামনগর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান, ১৬ জুলাই কালাছড়া বিট অফিসের সামনে একটি মুখপোড়া হনুমান, ২৪ জুলাই ভিক্টোরিয়া স্কুলের সামনে একটি বানর ও ১৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি বানরের মৃত্যু হয়।
চিঠি দেওয়ার বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও উদ্যানের পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে বিদ্যমান বৈদ্যুতিক লাইনের আবরণবিহীন তারের পরিবর্তে রাবারের বা অন্য বিদ্যুৎ অপরিবাহী মাধ্যমের আবরণযুক্ত তার প্রতিস্থাপন করতে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক বরাবরে চিঠি দিয়েছিলাম।
মৌলভীবাজার পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি নিজে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার স্থানগুলো সরেজমিনে দেখে এসেছি। এ বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা-প্রক্রিয়া চলমান আছে। আমি একটি কর্মপ্রস্তাবনা হেড অফিসে শিগগিরই পাঠাচ্ছি। সেখান থেকে অনুমোদন হয়ে আসলেই এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন), বাংলাদেশ এর ‘রেডলিস্ট’ অনুযায়ী চশমাপড়া হনুমান (Phayre’s Langur) বৈশ্বিক অবস্থায় ‘বিপন্ন’ এবং বাংলাদেশের অবস্থায় ‘মহাবিপন্ন’। লজ্জাবতী বানর (Bengal Slow Loris) বৈশ্বিক অবস্থায় ‘বিপন্ন’ এবং বাংলাদেশ অবস্থায় ‘মহাবিপন্ন’। লজ্জাবতী বানর (Bengal Slow Loris) বৈশ্বিক অবস্থায় এবং বাংলাদেশ অবস্থায় ‘বিপন্ন’। আর মুখপোড়া হনুমান (Capped Langur) বৈশ্বিক অবস্থায় ‘সংকটাপন্ন’ এবং বাংলাদেশ অবস্থায় ‘বিপন্ন’ তালিকাভুক্ত প্রাণী। এভাবে আর কিছু দিন চললে এই বনে বন্য প্রাণীর সংকট আরো ঘনীভূত হতে থাকবে যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হুমকির মুখে পড়বে।