১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্ররোচনায় একদল বিপদগামী তরুণ সেনা কর্মকর্তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করে। শেখ রাসেলকে হত্যা করার পূর্বে ব্যক্তিগত কর্মচারী আব্দুর রহমান রমাসহ তাকে খুনীরা আটক করে । আতঙ্কিত হয়ে শিশু শেখ রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে একথাগুলো বলেছিলেন, বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করেছিলেন।
শেখ রাসেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন ।
ভাই-বোনের মধ্যে অন্যরা হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সংগঠক শেখ কামাল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা শেখ জামাল এবং শেখ রেহানা। বেঁচে থাকলে আজ ২২ অক্টোবর ২০২১ শেখ রাসেলের বয়স ৫৭ বছর ৪ দিন হতো । কিন্তু তিনি চিরদিন ১০ বছরের শিশু রাসেল হয়েই বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের পাতায় ।
কনিষ্ঠ পুত্র হিসেবে পরিবারে শেখ রাসেলের আদর একটু বেশিই ছিল। বাবা শেখ মুজিব তাকে ভালোবাসতেন খুব। বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই খুঁজতেন রাসেলকে। রাসেল, রাসেল বলে ভরাট কণ্ঠে ডাক দিতেন আদরের ছোট্ট ছেলেকে। স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাজনৈতিক কারনে বেশীরভাগ সময়ই কারাগারে বন্দী থাকতেন। ফলে শেখ রাসেল বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শেখ রাসেল মা‘র সাথে কারাগারে যেতেন। সেখানে বাবার সাথে দেখা হতো। তার ধারনা ছিল, ধানমন্ডির ৩২ নং রোডের বাড়ীটি পরিবারের সকলের বাড়ী, কারাগার তার বাবার বাড়ি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাসেলকে সময় বেশ দিতেন। রাসেলও বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য, বাবার কোলে চড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকত সব সময়। বাবার ডাক শোনার সাথে সাথেই এক দৌঁড়ে ছুটে আসত বাবার কাছে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতেন একজন প্রিয় পিতা। পিতা-পুত্রের আনন্দঘন আড্ডায় পুরো বাড়ি যেন স্বর্গ হয়ে উঠত।
১৯৭২ সালে জাপানী চলচ্চিত্রকার Nagisa Oshima নির্মিত `Rahman, Father of Bengal` স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে জাপানি সাংবাদিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাতকার গ্রহণের সময় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লক্ষ্য করছি একটি ছোট্ট ছেলে সবসময় আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করে । ছেলেটি কে? কেন সে সবসময় আপনার চারপাশে থাকে?’
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছেলেটির বাবা জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কারাগারে থাকতো। ফলে সে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে । আমি তার বাবা, তাই সে সবসময় আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে’।
শেখ রাসেলের হাসু আপু ১৫ আগস্টের ভয়াবহ কালরাতের মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই (৩১ জুলাই) অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুদূর জার্মানীতে স্বামীগৃহে চলে গেছেন, সাথে আরেক বোন শেখ রেহানাও । “শেখ হাসিনা জার্মানীতে যাওয়ার সময়, ‘আমি হাসু আপুর সাথে যাবো, দেনা আপুর সাথে যাবো’ বলে খুব কেঁদেছিল রাসেল । শেখ রাসেল শেখ রেহানাকে ‘দেনা আপু’ বলে ডাকতেন”, শেখ রাসেল দিবস ২০২১ উদযাপন উপলক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ওয়াহিদা আক্তার একথাগুলো বলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও সেই হাসু আপুর কাছে যাওয়ার জন্যেই আকুতি-মিনতি করছিল, মায়ের পর হাসু আপাকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করেছিলেন তিনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব কৃষিবিদ ওয়াহিদা আক্তার আরও বলেন, ‘শেখ রাসেল এর হাসু আপু (শেখ হাসিনা) স্বামীর কর্মস্থল জার্মানে গিয়ে ছোট ভাই রাসেলের পছন্দের খেলনা কিনেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজও ঐসকল খেলার সামগ্রী আগলে রেখেছেন‘।
২০১৯ সালে শেখ রাসেলের জন্মদিনের আলোচনা সভায় বড়বোন শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘বন্দিখানায় থাকা অবস্থায় যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধের সময় যখন আক্রমণ হতো, রাসেল পকেটে সব সময় একটু তুলা রাখতো। নিজের কানে দেওয়ার পাশাপাশি ছোট্ট জয়ের কানেও তুলা দিয়ে দিতো, যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনও ক্ষতি না হয়। রাসেল জয়ের প্রতি খুব খেয়াল রাখতো । সব সময়ই তার সেদিকে বিশেষ নজর ছিল।’
অপর এক আলোচনায় শেখ রাসেলের জীবনের ইচ্ছে এবং তার কোমল হৃদয়ের চাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে এবং সেভাবে কিন্তু সে নিজেকে তৈরি করতো । ছোট ছোট গরিব শিশুর প্রতি তার দরদ ছিল, যখন সে গ্রামে যেতো গ্রামের অনেক শিশুকে সে জোগাড় করতো । সে কাঠের বন্দুক বানাতো । শিশুদের জন্য মাকে বলতো কাপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কিনে দিতেন । বাচ্চাদের সে প্যারেড করাতো।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তি জীবনের অজানা-অদেখা গল্প নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা: অ্যা ডটারস টেল’-এ বড়বোন শেখ হাসিনা ছোট ভাই রাসেল সম্পর্কে বলেছেন, ‘রাসেল হওয়ার (জন্মের) পরে আমরা ভাইবোনেরা খুব খুশি হই । যেন খেলার পুতুল পেলাম হাতে। ও খুব আদরের ছিল আমাদের। একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলতো। ওইটুকু একটা মানুষ, খুব স্ট্রং পার্সোনালিটি ।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে স্মৃতিচারণ করে তার ছোট ভাই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমাদের পাঁচ-ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন, স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম । আমার চুলের বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো। কারণ, নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেতো।’
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকলের এতো আদরের ছোট্ট রাসেল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতের শেষ প্রহরে মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে বাচার জন্য মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকলে নরপিশাচরা, মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে, গৃহকর্মী ও খেলার সাথী আব্দুর রহমান রমার হাত থেকে হেঁচকা টান দিয়ে শেখ রাসেলকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পরবর্তি সময়টুকু তাঁর কেমন কেটেছিল, কতটুকু মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক হয়েছিল তা ঐ ঘাতকেরাই জানে । তবে বাহ্যিক চোখ বন্ধ করে হৃদয়ের চোখ দিয়ে যদি দেখি বা অনুমান করি তবে হয়তো এইভাবে বলা যায়, ‘মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার পথে দেখলো সিঁড়িতেই পরে আছে তার বাবার লাশ । হতভম্ব শিশু শেখ রাসেল । নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। এ কি করে হয়? তাঁর বাবা, যিনি বাঙালি জাতির পিতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ পরে আছে সিঁড়িতে? কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেনে হেঁচড়ে তাঁকে নিয়ে গেল মায়ের কাছে । মায়ের লাশ দেখে মায়ের বুকে আছড়ে পড়েছিল- মা, মা বলে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে আর্তনাদ করেছিল । মায়ের কোন সাড়া পায়নি । মা তাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে বলেনি, ‘ভয় নাই বাবা। কিচ্ছু হবে না । আমি আছি তোমার কাছে’। মায়ের নিথর দেহ পরে আছে মাটিতে । মা-বাবার পর ঐ ছোট্ট শিশু দেখলো সদ্যবিবাহিত তার বড় ভাই, মেঝ ভাই, বড় ভাবী, মেঝ ভাবীর লাশ’। কি বেদনাদায়ক এই দৃশ্য।
আমরা পরিবারের একজন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যতে ভেঙ্গে পরি, চাপা ব্যথা অনুভব করি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, আর্তনাদ করি । অথচ ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল অল্পক্ষণের মধ্যে বাবা-মাসহ নিজ পরিবারের এতজন সদস্যের মৃত্যু এবং তাঁদের সারিসারি লাশ দেখার অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছেন । তখন হয়তো ভেবেছেন, হাসু আপু, দেনা আপুর সাথে বেড়াতে গেলেই ভালো হতো । হয়তো ভেবেছেন, হাসু আপু আমাকে নিয়ে গেল না কেন? ঐ মূহুর্তে শেখ রাসেলের মনের অবস্থা অনুভব করার বোধশক্তিও আমার নাই । শেখ রাসেলের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে এই যন্ত্রণা ভোগ করেছিল । এমনি অবস্থায় হঠাৎ গর্জে উঠলো ঘাতকের আগ্নেয়াশ্র, ঝাঁঝড়া হয়ে গেল শেখ রাসেলের বুক, ঘাতকেরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সাঙ্গ করে দিল তাঁর স্বজন হারানোর অসহনীয় বেদনা।
পরম করুনাময় মহান আল্লাহ শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন
ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী ও কলামিস্ট, ঢাকা, বাংলাদেশ।