চীনে অবস্থানরত কমপক্ষে ৩৪টি জাপানী প্রতিষ্ঠান তাদের ইউনিটগুলি বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। বেইজিংয়ে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস গত বুধবার এই বিষয়টি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করেছে।
কয়েক ডজন জাপানি সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বর্তমানে চলা বাণিজ্য যুদ্ধ এবং কাঁচামাল ও পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা ব্যাহত হওয়ার কারণে চীন ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
বেইজিংয়ের জেট্রো কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দূতাবাস জানিয়েছে যে, মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করার জন্য জাপান সরকার দ্বারা প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পরেও চীনে নিবন্ধিত ৬৯০ টি জাপানি সংস্থার মধ্যে ৩৪ টি প্রতিষ্ঠান অন্যত্র স্থানান্তর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।
জেট্রো কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, বিনিয়োগ-বান্ধব গন্তব্য হিসাবে বাংলাদেশ আকর্ষনীয় ও স্বীকৃত এক দেশ। তবে তারা চীন থেকে স্থানান্তরিত করতে ইচ্ছুক এমন জাপানী প্রতিষ্ঠান গুলির নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এর আগে, বেইজিংয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইয়ুতাকা ইয়োকোয়ের সাথে দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের প্রতিষ্ঠান গুলি চীন থেকে স্থানান্তরিত করার গন্তব্য হিসাবে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে, গত বছরের ১৩ ই মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি বা ইউএসটিআর অফিস ৩,৮০৫ টি পণ্য বিভাগের তালিকা প্রকাশ করেছে যাতে শুল্কের পরিমাণ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ফলে চীনের তৈরি পণ্যের উপর এরুপ মার্কিন শুল্ক আরোপ করা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বারা চালিত বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র হওয়ার কারনেই মুলত জাপানী প্রতিষ্ঠান গুলি চীন ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছে। জাপানী প্রতিষ্ঠান গুলির এই স্থান পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তের পিছনে তারা মুলত দায়ী করছে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নতা আর বাণিজ্য যুদ্ধের কারনে পণ্য উৎপাদনে চীনে উচ্চ ব্যয়। যা জাপানী প্রতিষ্ঠান গুলিকে আর্থিকভাবে সরাসরি আঘাত করেছে।
এছাড়া, মাজদা মোটরের অটো পার্টস প্রস্তুতকারকরা চীনের জিয়াংসু প্রদেশ থেকে মেক্সিকো যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হোন্ডার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কাসাই কোগিও এখন উহান থেকে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
এদিকে, করোনা-পরবর্তী সময়ে ১৬টি জাপানী প্রতিষ্ঠানের চীন ছাড়ার তথ্য পাওয়া যায়। যদিও এসব কারখানার একটির গন্তব্যও বাংলাদেশ নয়।
বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে একটি চিঠির মাধ্যমে এইসব বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এরই মধ্যে, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম ১২ মে জাপানের বহিরাগত বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধিকে একটি চিঠি লিখেছেন। এতে বলা হয়েছে, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী।
এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে আনুক। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা দিতে তারা আগ্রহী। সংগঠনটি একই ধরনের চিঠি দিয়েছে আঞ্চলিক বাণিজ্য সংগঠন কনফেডারেশন অব এশিয়া-প্যাসিফিক চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিকেও (সিএসিসিআই)।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাপানিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো করপোরেশন। এটি ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানান বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ২ হাজার একর জমি তৈরি রাখা হচ্ছে।
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) মহাসচিব তারেক রাফি ভূঁইয়া জানান, ‘কর্মরত জাপানি কোম্পানিগুলো যেসব সমস্যার মুখে রয়েছে, সেগুলো সমাধান করলে তারাই বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করবে।’ তিনি আরও তিনটি পরামর্শ দেন। প্রথমত, জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ দ্রুত শেষ করে জমি বরাদ্দ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। তৃতীয়ত, ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ জানান, ‘হতে পারে ১৫ বছরে যে বিনিয়োগ পাওয়ার কথা, সেটা আমরা ৪ বছরে পাব। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি।’
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসাসূচক বা ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ৭০, থাইল্যান্ড ২১ ও ইন্দোনেশিয়া ৭৩তম।