তিমির বনিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার ৫ ইউনিয়নের লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীকে জরুরি চিকিৎসাসেবা পেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। কুলাউড়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী হওয়ায় সীমান্তবর্তী এলাকা শরীফপুর, হাজীপুর, পাহাড় অধ্যুষিত কর্মধা ইউপি এবং হাকালুকি তীরবর্তী বরমচাল ও ভূকশিমইল অঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী তাদের কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন নানা কারণে। দূরবর্তী এসব এলাকার রোগীরা বিশেষ করে নারীদের প্রসবসহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সেবা নিতে বিলম্ব হওয়ায় তারা অনেক সময় ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। এসব অঞ্চলের কথা মাথায় রেখে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অন্তত ১০ অথবা ২০ শয্যার হাসপাতাল স্থাপন করলে তাদের চিকিৎসার মতো একটি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী এলাকার সাধারণ জনগণ ও জনপ্রতিনিধিরা।
১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুলাউড়া উপজেলার প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। হাসপাতালটি ৫০ শয্যার হওয়ায় দূরবর্তী এসব এলাকার রোগীরা হাসপাতালে এসে তাৎক্ষণিকভাবে বেড খালি পান না। তাদের যেতে হয় মৌলভীবাজার কিংবা সিলেটে। এতে করে রোগীদের সংকটাপন্ন পরিস্থিতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ছাড়াও আর্থিক খরচসহ যাতায়াতের জন্য চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অন্যদিকে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা নিতে গিয়ে মানুষজন প্রতিনিয়ত নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
জানা যায়, জনবহুল ও প্রত্যন্ত অঞ্চল উপজেলার বরমচাল, শরীফপুর, কর্মধা, হাজিপুর, ভুকশিমইল ইউনিয়নে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কয়েক লক্ষ জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা পেতে চরম রকমের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এছাড়া বরমচাল ও পাহাড় অধ্যুষিত কর্মধা ইউনিয়নে পাহাড়ের ভেতরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাসিয়া পুঞ্জির রয়েছে। সেই সকল পুঞ্জির জনগোষ্টীর লোকজন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রতিটি গ্রাম থেকে উপজেলা সদরের দূরত্ব ২০-৩০ কিলোমিটার। রাত হলেই পাওয়া যায় না কোনো ধরনের যানবাহন।
তাছাড়া যোগাযোগব্যবস্থাও তেমন ভালো না থাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লোকদের স্বাস্থ্যসেবা পেতে চরম ভোগান্তি পেতে হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো সেবার নামে কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বিশেষ করে প্রসূতি মহিলাদের ডেলিভারি করাতে হচ্ছে। প্রায়ই ভুল চিকিসার কারণে শিশু ও প্রসূতি মারা যাচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে এসডিজির আলোকে মাতৃ মৃত্যু কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবার এই পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উপজেলা হাসপাতালে গাইনী ডাক্তারের অভাব রয়েছে।
জানা গেছে, কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল, ব্রাহ্মণবাজার, কর্মধা, পৃথিমপাশা ও হাজিপুর ইউনিয়নে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে একটি কেন্দ্রেও মেডিকেল অফিসার দায়িত্বে নেই। এছাড়া কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনী বিশেষজ্ঞ না থাকায় এখানে প্রসূতি অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। তবে নরমাল ডেলিভারি কার্যক্রম চলমান আছে।
সীমান্তবর্তী শরীফপুর ইউনিয়নের তেলিবিল গ্রামের বাসিন্দা জামাল আহমদ বলেন, উপজেলা সদর থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী এই ইউনিয়নের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মানুষের জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে সীমিত শয্যার হাসপাতাল তৈরির জোর দাবি জানাচ্ছি।
কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী ও আদিবাসী নেত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকজন সবসময় যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। কেউ অসুস্থ হলে কিংবা প্রসূতি নারীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য কাঁধে করে রোগীদের বহন করে স্থানীয় বাজারে এসে গাড়ি দিয়ে উপজেলা সদর কিংবা জেলা সদরে যেতে হয়। পুঞ্জির লোকসহ বস্তি এলাকার দরিদ্র মানুষের আর্থিক খরচের কথা চিন্তা করে জনবহুল কর্মধা ইউনিয়নে যদি সরকার একটি ২০ শয্যার হাসপাতাল তৈরি করে তাহলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর হবে।
হাওর তীরের ভূকশিমইল ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, হাওর অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ সদর হাসপাতাল দূরবর্তী হওয়ায় তারা যেতে পারে না। ফলে গ্রামের পল্লী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। এতে বিভিন্ন সময় মৃত্যুসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে থাকে। মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ভূকশিমইল, বরমচাল ও ভাটেরা ইউনিয়নের মধ্যেবর্তী স্থানে যদি ২০ শয্যার হাসপাতাল করা যায় তাহলে এই তিন অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা ভোগান্তি দূর হবে। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আমি সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছি, এখানে যেন হাসপাতাল তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফেরদৌস আক্তার বলেন, গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে মানুষদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। কুলাউড়া হাসপাতালে রোগীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। জরুরি প্রসূতি অস্ত্রোপচার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রসূতি অস্ত্রোপচারে গাইনী বিশেষজ্ঞ নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ফেরদৌস আক্তার বলেন, অনেক কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার ছিল। কিন্তু করোনার কারণে রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য তারা কুলাউড়া হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে মাঝেমধ্যে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসাররা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি সীমিত শয্যার হাসপাতাল করা যায় তাহলে মানুষের ভোগান্তি কিছুটা দূর হবে বলে মনে করেন তিনি।