মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন চেতনার দেশমাতৃকার মুক্তির পথে একজন বীরশ্রেষ্ঠের জীবনদানের গল্প আঁকড়ে আছে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুর ইউপি’র ধলই চা বাগানে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান। তার স্মৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, জাদুঘর ও আর্কাইভ। আজ আমরা জানবো কমলগঞ্জে অবস্থিত ধলই চা বাগানের স্মৃতি বিজরিত জায়গাগুলোর কিছু কথা।
মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ হামিদুর রহমানকে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন যশোর জেলার মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে। বাবা আব্বাস আলী মন্ডল ও মা মোসাম্মাৎ কায়সুন্নেসা কোলে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। ১৯৭০ সালে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিপাহি পদে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে গ্রামে পালিয়ে আসেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ৪নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি।
যেভাবে শহীদ হলেন হামিদুর রহমান: ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সিলেটের কমলগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করছিলেন। দলের অধিনায়কের নির্দেশে ২৮ অক্টোবর সকালে হামিদুর রহমান ধলই বিওপিতে পাকিস্থানীদের ঘাটি দখলের জন্য অগ্রসর হন। একটি মেশিনগান নিয়ে জীবন বাজি রেখে হামিদুর রহমান একাই দুইটি পাকিস্থানি যুদ্ধ ট্যাংক ধ্বংস করেন। এতে শত্রুঘাটির অধিনায়ক ও বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। একসময় যুদ্ধরত অবস্থায় এই বীর সন্তান শত্রুদের পাল্টা আক্রমনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার আত্মত্যাগের কয়েকদিনের মধ্যেই ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সহযোদ্ধারা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের ওপারে নিয়ে ভারতের আমবাসা গ্রামের একটি মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর: স্বাধীনতার ২০ বছর পর ১৯৯২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ধলই চা বাগানের বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতি রক্ষার্থে তার স্মরণী উদ্বোধন করেন সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবির পক্ষে (তৎকালীন বিডিআর) লে. কর্ণেল মো: বজলুল করিম একটি নামফলক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। পরে ২০০৩ সালে ৩০ এপ্রিল ধলই চা বাগানের ধলই বিওপি সংলগ্ন ৭৪ শতাংশ জমির উপর বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মরণে পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন সরকার দলীয় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম. সাইফুর রহমান। বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলে স্মৃতিসৌধ উন্নয়ন করেন ও তার পাশে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবি’র বর্তমান ক্যাম্পের সামনে আছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান’ স্মৃতি আর্কাইভ। সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের ছোটবেলার ছবি, আছে তার পারিবারিক তথ্য ও ছবি। যা বাস্তবায়ন করেছে ৪৬ বিজিবি ও শ্রীমঙ্গল সেক্টর। এছাড়া ভানুগাছ চৌমুহনী হতে মাধবপুর ও পাত্রখোলা প্রধান সড়ক’কে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সড়ক নামকরণ করা হয়েছে।
স্মৃতিসৌধ শ্রদ্ধা ও সমাধি হস্তান্তর: প্রতি বছর ২৮ অক্টোবর কমলগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল, বিজিবি ব্যাটালিয়ন কমান্ডের উদ্যোগে দলই সীমান্তে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের কবর নিয়ে সাংবাদিকদের তৎপরতা ও স্থানীয়দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের মরদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করেন। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
কীভাবে যাবেন স্মৃতিসৌধে: বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে যেতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় যেতে হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক ও রেলপথে কমলগঞ্জ আসা যায়। ঢাকার ফকিরাপুর কিংবা সায়েদাবাদ থেকে হানিফ, শ্যামলী, এনা ও সিলেট পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাসে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে পারবেন। এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা, উপবন বা পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেনেও কমলগঞ্জ যাওয়া যায়।অথবা শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশন থেকে যে কোন যানবাহন ব্যবহার করে গন্তব্য যেতে অসুবিধে হবেনা। কমলগঞ্জের ভানুগাছ রেলস্টেশন হতেও স্থানীয় পরিবহনে (সিএনজি, রিকশা) চড়ে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে যেতে পারবেন।