আপনি গর্ভবতী কিনা তা কিছু লক্ষন বা উপসর্গের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা যেতে পারে। সাধারণত পিরিয়ড মিস হওয়ার ১ বা ২ সপ্তাহ মাঝে কিছু লক্ষণ আপনার সম্মুখে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। এসব লক্ষণগুলো শতকরা ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জন মহিলার ক্ষেত্রেই গর্ভধারণের প্রথম ৬ সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায়।
আপনি যদি আপনার পিরিয়ডের ডেটের হিসাব না রাখেন অথবা আপনার পিরিয়ড যদি সঠিক সময় মেনে না হয়, তবে আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না কখন পিরিয়ড হওয়া উচিত। এমন সময় আপনি হয়তো সময়মতো পিরিয়ড না হবার কারণ নিয়ে চিন্তিত। তখন যদি আপনি নিচের কোন একটি উপসর্গ নিজের মাঝে দেখতে পান, তবে খুব সম্ভবত আপনি গর্ভবতী। নিশ্চিত হতে নিচের উপসর্গগুলো মিলিয়ে নিন এবং বাসায় বসেই একটা টেস্ট করে ফেলুন।
- পিরিয়ড মিসঃ আপনার পিরিয়ড যদি সঠিক চক্র মেনে চলে এবং ঠিক সময়ে যদি আপনার পিরিয়ড না হয়, তবে উপরের উপসর্গগুলো দেখা না গেলেও আপনি বাসায় বসেই প্রেগনেন্সি টেস্ট করার কথা চিন্তা করতে পারেন। তবে আপনার পিরিয়ড যদি অনিয়মিত হয়, এবং আপনি যদি এর ঠিকমতো হিসাব না রাখেন, তবে বমি ভাব, স্তনে ব্যাথা এবং বেশি বেশি বাথরুমে যাওয়ার দিকে খেয়াল করুন।
- শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিঃ বর্ধিত শারীরিক তাপমাত্রা যদি আপনি নিয়মিত আপনার শরীরের তাপমাত্রার চার্ট রেখে থাকেন, এবং যদি দেখেন একনাগাড়ে ১৮ দিনের বেশি তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, তবে খুব সম্ভবত আপনি গর্ভবতী।
- হালকা রক্তপাত বা স্পটিংঃ সহবাসের পর নিষিক্ত ডিম্বানু নিজেকে জরায়ুর দেয়ালে আটকে নেয় স্পটিং ও সাদা স্রাব এর মাধ্যমে। এসময় স্পটিং (স্বল্প রক্তপাত) ও মাসিকের ব্যাথার মতো ব্যাথা হতে পারে এবং এগুলো গর্ভধারণের খুব প্রাথমিক সময়ের লক্ষণ। এধরনের স্পটিংকে Implantation bleeding বলে, যেটা গর্ভধারণের ৬ থেকে ১২ দিনের মাঝে হতে পারে। এসময়ের ব্যাথার ধরণ মাসিকের ব্যাথার সাথে মিলে যাওয়ায় অনেক নারী এক মাসিক মনে করে ভুল করেন, সাথে স্পটিং তাদের ভুল ধারণাকে পোক্ত করে।তবে খুব শিঘ্রি তাদের ভুল ভাঙে, কারণ ব্যাথা বা রক্তপ্রবাহ খুবই স্বল্প পরিমাণে হয়ে থাকে। এছাড়া মহিলারা এসময় সাদা স্রাব দেখতে পারেন। ডিম্বানু নিষিক্ত হওয়ার পরে যোনির অভ্যন্তরে পরিবর্তনের কারণে এটা হয়ে থাকে। এই স্রাব অনেকের ক্ষেত্রে পুরো গর্ভাবস্থায় চালু থাকে, এতে আতংকিত হবার কিছু নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি স্রাবের দুর্গন্ধ থাকে এবং জ্বালাপোড়া বা চুলকানির অনুভূতি হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার, যাতে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন কোন ইস্ট বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়নি।
- বমি বমি ভাবঃ সাধারণত গর্ভধাণের এক মাসের আগে বমি বমি ভাব দেখা দেয় না। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে যাদের গর্ভধারণের দুই সপ্তাহের মাঝেই বমিভাব দেখা দেয়। সাধারণত সকালেই এই বমিভাব হয়, তবে অনেকের এই সমস্যা সময় মেনে চলে না। প্রায় অর্ধেকের মতো গর্ভবতী মহিলা তাদের দ্বিতীয় ট্রিমেস্টারের শুরুতে বমিভাব থেকে মুক্তি পায়, আর বাকিদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আর মাসখানেক দীর্ঘায়িত হতে পারে। তবে এই বমিভাব একেবারে পুরোপুরি নিরাময় হয় না কখনো। খুব কম সংখ্যক, শতকরা দশজন ভাগ্যবতী মহিলা এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে থাকেন।
- স্তন স্ফীত হওয়াঃ স্তন কোমল ও স্ফীত হওয়া গর্ভধারণের পর শরীরে বিশেষ কিছু হরমোন প্রবাহের কারণে স্তনযুগল বেশ স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে, যা কি না গর্ভধারণের আরেকটি চিহ্ন। স্তনের এই ফুলে ওঠা এবং ব্যাথা অনেকটা মাসিক পূর্ববর্তী অবস্থায় ব্যাথার মত। তবে সুখের খবর, এই ব্যাথাযুক্ত অবস্থা প্রথম ট্রিমেস্টারেই শেষ হয়ে যাবে, কারণ এই সময়ের মাঝে আপনার শরীর এই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
- অবসন্নবোধঃ মাঝেমাঝেই আচমকা ক্লান্ত বোধ করছেন? কিংবা ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ছেন? এখন অবধি কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি সন্তান সম্ভবা মা’র প্রথম দিকের ক্লান্তির কারণ কী। তবে ধারণা করা হয় সম্ভবত প্রোজেস্ট্রেরন হরমোনের ক্রমবর্ধমান প্রবাহ আপনাকে এই ঘুম ঘুম অনুভুতি দিচ্ছে। তাছাড়াও মর্নিং সিকনেস ও বার বার প্রস্রাব করাও আপনার ক্লান্তিবোধ বাড়াতে কাজ করছে। তবে, ভাল খবর হচ্ছে, দ্বিতীয় ট্রিমেস্টার শুরুর সাথে সাথে আপনার এই ক্লান্তিবোধ কেটে গিয়ে আগের চেয়েও বেশি ভাল বোধ করবেন। তবে গর্ভাবস্থার শেষ দিকে এই ক্লান্তিবোধ আবার ফিরে আসে, কারণ তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি আগের তুলনায় অনেক বেশি ওজন বহন করবেন এবং সে সময়ের বিশেষ কিছু উপসর্গ আপনার রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগঃ হরমোন জনিত পরিবর্তনের কারণে এসময় শরীরে যে ক’টি পরিবর্তন আসে তার মধ্যে একটি হল রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি। আর এই রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য প্রস্রাবের বেগ সৃষ্টি হয়। এই উপসর্গ টি আপনার প্রথম ট্রিমেস্টার বা ৬ সপ্তাহের মাথায় দেখা যাবে। এই অবস্থা বেশ কিছুদিন চলতে থাকবে। এবং আপনার শরীরে বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে এই সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে।
- পেট ফুলে যাওয়াঃ হরমোন জনিত পরিবর্তনের কারণে এ সময়টাতে সন্তান সম্ভবা মায়ের পেট ফুলে যাওয়ার মত একটা ব্যাপার অনুভুত হয়। এসময় আপনার এরকম মনে হতে পারে যে, পরিধেয় বস্ত্র কোমরের পরিমাপের থেকে ছোট হয়ে গেছে, যদিও এখন পর্যন্ত আপনার জরায়ুতে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি।
- মন মেজাজের উঠানামাঃ এসময় মন মেজাজ এর কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না। অবশ্য না থাকাই স্বাভাবিক। এমন মুড সুইংয়ের বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে অবশ্য। সন্তান সম্ভবা মায়ের শরীরে এসময় হরমোন এর নানা পরিবর্তনের কারণে ব্রেনের অভ্যন্তরে মেসেজ বহনকারী নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমানে পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন বিভিন্ন জনে বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। সম্ভবা মা এসময় বেশ আবেগী অনুভব করেন, আবার অনেকে এসময় বিষন্নতা/দুশ্চিন্তায় ভোগেন।
- খাবারে অনীহাঃ গর্ভবস্থার শুরুর দিকে খাবারে অনীহা বোধ হওয়া বেশ স্বাভাবিক। যদি কোন খাদ্যদ্রব্যের (যেমন পেয়াজ) গন্ধ আপনার মাঝে বমি ভাব নিয়ে আসে তবে খেয়াল করুন এমনটা ক্রমাগত হচ্ছে কি না। এসময় বমি ভাব বা খাদ্যে অনীহার কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তবে খুব সম্ভবত আপনার শরীরে ক্রমবর্ধমান ইস্ট্রোজেন হরমোনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এটা। এসময় আপনার খুব পছন্দের কোন খাবার খেতে বিস্বাদ লাগলেও আশ্চর্য হবেন না। বরং এরকমই হয়ে থাকে!
গর্ভাবস্থার লক্ষণ এবং পর্যায়গুলি সবার মধ্যে একই রকম হয় না। আপনি যে লক্ষণ বা উপসর্গ গুলি লক্ষ্য করেছেন তার কয়েকটি হয়তো কোনো একটি মেডিকেল অবস্থার কারণে হতে পারে যেটির বিষয়ে আপনি অবগত নাও থাকতে পারেন আগে থেকে। আবার শুধুমাত্র উপরে তালিকাভুক্ত উপসর্গগুলিই কেবল মাত্র গর্ভাবস্থাকে নিশ্চিত করবে এমনটাও নয়। উপরে উল্লিখিত নির্দেশকগুলির প্রতি কেবল মাত্র নজর রাখতে পারেন যদি আপনি একটি পরিবার শুরু করার পরিকল্পনা করেন । এও সম্ভব যে এই লক্ষণগুলির কোনোটিই আপনি দেখলেন না এবং তা স্বত্বেও গর্ভবতী হলেন এবং একটি পুরোপুরি স্বাভাবিক শিশু পেলেন।
গর্ভধারণ শুধুমাত্র যখন আপনি পিরিয়ড মিস করেন, বা গর্ভাবস্থার পরীক্ষা কিট দ্বারা এবং সব ক্ষেত্রেই আপনার হেলথ প্র্যাক্টিশনার দ্বারা প্রত্যয়িত রক্ত পরীক্ষা দ্বারা নিশ্চিত করা যেতে পারে। আপনি গর্ভবতী কি না তা নিশ্চিত হবার আগে থেকেই বাচ্চার গঠন শুরু হয় (যদি আপনি গর্ভধারণ করেন) এবং প্রাথমিক অবস্থায়ই আপনার নিজের যত্ন নেয়া জরুরী। তাই এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।