প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল না করা হলে আগামী যে কোন সময় বৃহৎ আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে এ-সব কথা বলেন শিক্ষার্থীরা।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাতিল হওয়া কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। কোটা বাতিলের সেই প্রজ্ঞাপন গত ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হয় হাইকোর্টের রায়ে। এর প্রেক্ষিতে আবারও বহাল হলো ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
ফলে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের আদেশের পর থেকেই ফের আন্দোলনে নেমেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, সড়ক অবরোধ করেছেন তারা।
অবিলম্বে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের ফলে কোটাবিহীন শুধু মেধা নিয়ে যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিবেন তাদের জন্য চাকরিপ্রাপ্তি হয়ে উঠছে ‘অমাবস্যার চাঁদ’ এবং মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য উচ্চশিক্ষা হয়ে উঠেছে একপ্রকার বিলাসিতা। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিমজ্জিত হচ্ছে তীব্র হতাশায়। এই রায় পরিবর্তন না হলে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, চাকরিতে কোটা পদ্ধতি থাকলে মেধাবীরা বঞ্চিত হবে এবং তাদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়বে। এতে মেধাশূন্য হবে দেশ। তবে অনগ্রসর ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটা যুক্তিযুক্ত উল্লেখ করে তারা বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন যোক্তিকতা দেখছি না।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়েদ আবদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯, ২৮(১),২৮(২),২৯(১) অনুযায়ী চাকরি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে সবাইকে যেন সমানভাবে দেখা হয় এবং কারও প্রতি বৈষম্য না করা হয় এসব ব্যাপার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। তবে অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এবং ২৯(৩)(ক) অনুসারে অনগ্রসর কোন গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য সরকার যদি বিশেষ সুবিধা দিতে চায়, সেটা পার্মিসিবল। কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি বলতে এই এতটুকুই। এখন গণহারে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালুর মানে তো তাহলে এটা দাঁড়ায় যে মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধর যারা আছে, সবাই অনগ্রসর। এটা কি যৌক্তিক এবং সত্য ঘটনা হতে পারে?
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা অবশ্যই রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কেন কোটা সুবিধা পাবে? ২০২৪ সালে স্বাধীনতার ৫৪তম বছর চলছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলেমেয়ে যারা আছে, তারা ইতোমধ্যেই বিশাল বড় একটা অংশ কোটার সুবিধা নিয়ে নিয়েছে। চিন্তা করে দেখেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার যদি ৩-৪ জন সন্তান থাকে, এই ৩-৪ জন সন্তানের আবার প্রত্যেকের যদি ২-৩ জন করে সন্তান থাকে, এরা প্রত্যেকেই কিন্তু কোটার আওতায় আসবে, তার মানে একজন মুক্তিযোদ্ধার বিপরীতে চক্রবৃদ্ধি হারে কোটার ভোক্তা বাড়ছে। এতে অন্যদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।
আব্দুল্লাহ বলেন, বর্তমানে প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং বিশেষ বিবেচ্য অন্য কেউ কোটা সুবিধায় আসতে পারে, তবে সামগ্রিক সব হিসাব মিলিয়ে কোনো অবস্থাতেই ৫ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে চাইলে নানা উপায় আছে, তাদের নাতি-নাতনি এবং সন্তানদের সব জায়গায় কোটা দেওয়াটাই কি তাদের সম্মানিত করার একমাত্র উপায়?
১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে একটা ছেলে চোখ হারিয়েছিলেন। আরো অনেকে অনেকভাবে আহত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এটা একটা যৌক্তিক ইস্যু। এই ইস্যুটা অনেক আগেই সমাধান করা উচিত ছিল। এখন যে আবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে এটা দুঃখজনক। আমি শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক মনে করি।
তিনি বলেন, হাইকোর্ট কোনো বিষয়ে রায় দিলেই সে বিষয়টা ন্যায়সঙ্গত হবে এমন মনে করার কারণ নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের আদালতের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদালত স্বাধীনভাবে রায় দেওয়ার কিছুটা ক্ষমতা রাখে, তবে তা রাষ্ট্র যদি চায়। হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা অবশ্যই লিখিত দলিল দেখেই রায় দিয়েছে বলে মনে করছি, সেটা হাইকোর্টের জন্য ভালো; কিন্তু যখন একটা অন্যায়, অযৌক্তিক বিষয় আইনসিদ্ধ থাকে তখন সেখানে হাইকোর্টের উচিত ছিল রাষ্ট্রকে জানানো যে, এমন একটি বিষয় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই থাকা উচিত, অনন্তকাল থাকবে এরকম না। সরকারকে আহ্বান করতে হবে যে যত দ্রুত সম্ভব আইন প্রণয়ন করে বিষয়টা সমাধান করা হোক।
প্রফেসর আবুল কাসেম বলেন, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের চেয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সংসদ অনেক বেশি পাওয়ারফুল। সেখানেই আইন প্রণয়ন করা হয় এবং আদালতে তা বাস্তবায়ন করা হয়। সুতরাং এই বিষয়টা জাতীয় সংসদে সমাধান হওয়া উচিত। ড. আবুল কাসেম বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারা কি কোনো রিটার্ন (বিনিময়) পাওয়ার জন্য করেছিলেন? তারা তো নিজের কর্তব্যবোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। আমাদের অধিকার আদায়ে তারা লড়াই করেছিল, যেখানে ছাত্রদের আন্দোলনই অগ্রগামী ছিল। কিন্তু এখন স্বাধীনতার এত বছর পর এসেও সেই ছাত্রদের আন্দোলনকেই উপেক্ষা করা হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাবো অতি দ্রুত বেশি সময় না নিয়ে আইন সংস্কার করা হোক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাকসুদুর রহমান কোটা বহালের রায়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, যে বছর কোটা বাতিল করা হয় তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। কোটা বাতিলের ঘোষণাটা ঐ সময় খুবই আনন্দের খবর ছিল। মেধাবীরা তাদের পরিশ্রমের ফল পাবে এই ভেবে ভালো লাগছিল। হয়েছিলও তাই। বর্তমানে এই তীব্র প্রতিযোগিতার চাকরির বাজারে আমিও একজন চাকরিপ্রার্থী। কিন্তু হাইকোর্টে কোটা বহাল রায় আমাকে হতাশায় ফেলে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কোটা বিদ্যমান থাকলে মেধাবীরা বঞ্চিত হবে। যে বৈষম্য দূর করার জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে বৈষম্য আবার ফিরে এসেছে।
ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পার হলেও সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়নি বলেই কোটা বহাল রেখে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। বৈষম্যমূলক এই রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগের প্রফেসর এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, অনগ্রসর এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা রাখা যুক্তিযুক্ত। তবে স্বাধীনতার এত বছর পর এসে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটার কোনো যোক্তিকতা দেখছি না। মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কখনো কোনো প্রলোভনে আপস করেননি। তাদের আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাতে পারি। তিনি বলেন, আমার জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটি পর্যন্ত নেননি। দেশ থেকে কোনো প্রকার সুবিধা নেবেন এই অভিপ্রায় তাদের ছিল না। কিন্তু এত বছর পর এসে তাদের স্বজনদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা কেবল বৈষম্যই বাড়াবে।
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রফেসর শামছুল আলম বলেন, এ দেশের ইতিহাস বলে বাংলাদেশে যখনই দুর্নীতির কালো ছায়া পড়েছে তখনই শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে এনেছে। দেশ বর্তমানে আবারও যখন দুর্নীতি, লুটপাটে নিমজ্জিত তখনই কোটা ইস্যুকে সামনে এনে ছাত্রসমাজকে দমিত করার লক্ষ্যে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আলোচিত বেনজীর, আনার, আজিজ ইস্যুকে আড়াল করতেই সরকার আদালতকে ব্যবহার করে এই রায় দিয়েছে। একবার কোটা বাতিলের পর আবার ফিরিয়ে আনার ফলে মেধাবীরা বঞ্চিত হবে। তাদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়বে। ফলে অবধারিত মেধাশূন্য জাতি গড়ে উঠবে।
ডিবিএন/ডিআর/তাসফিয়া করিম