করোনা ভাইরাসের কারণে কমেছে সিজারিয়ান সেকশন, বেড়েছে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব। এক যুগ আগেও মানুষ হাসপাতালে না গিয়ে ধাত্রীর মাধ্যমে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করাতেন। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোতে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর বাণিজ্যিক কারণে অন্যদিকে প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারার ভয়ে অভিভাবকদের পীড়াপীড়িতে সিজারে সন্তান প্রসবের হার অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছেন প্রসূতিরা। করোনা মহামারির কারণে প্রসূতিরা হাসপাতালে যেতে ভয় পাওয়ায়, এমনটি হয়েছে। তবে কারণ যা-ই হোক, অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধ তথা স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের এই ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারকে নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। স্বাভাবিক ডেলিভারিও হাসপাতালে করানোর পরামর্শ দেন তারা।
করোনা মহামারির আগে দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু জন্ম হতো সিজারে। আর সারা দেশের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ৯৫ শতাংশ ইনকাম ছিল সিজার থেকে। করোনার মধ্যে বাংলাদেশে সিজারের সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর হার বাড়েনি। সাধারণত প্রসূতির শারীরিক জটিলতার ক্ষেত্রে মা ও সন্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে সিজারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিত্সকরা। তবে কতিপয় অসত্ চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে, দিন দিনই বেড়ে চলছিল এই সিজার অপারেশনের সংস্কৃতি। অনেক ক্লিনিক সিজারে প্যাকেজ সিস্টেম করে দেয়। ১০০ রোগীর মধ্যে ৮০ জনেরই সিজার করায় ঢাকার বাইরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলো। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালকদের (স্বাস্থ্য) বিষয়টি মনিটরিং করার কথা থাকলেও অনেকে তা সঠিকভাবে করেন না। অনেকে নিয়মিত মাসোহারা পান। গ্রামাঞ্চলের অনেক ক্লিনিকের লাইসেন্সও নেই। ১০ হাজার ভুয়া চিকিত্সক এখনো প্রাকটিস করে যাচ্ছেন।
এদিকে মা ও সন্তানের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসব সিজারিয়ান বা সি-সেকশনে করানোর সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে এর হার ৫১ শতাংশ। গত এক দশকে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সিজারের সংখ্যা নানা অজুহাতে বেড়েই চলছিল। তবে সাম্প্রতিক করোনা মহামারির কারণে এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।
এই সিজার বা অস্ত্রোপচারের বিরুদ্ধে সন্তান জন্মদানের বিষয়টাকে নিরুত্সাহিত করতে কয়েক বছর আগে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে— স্টপ আননেসেসারি সি-সেকশন নামে একটি প্রচারণা। মূলত সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবিসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে এটি গড়ে ওঠে। ২০১৯ সালের জুনে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারের হার ৮৩ শতাংশ, সরকারি হাসপাতালে ৩৫ শতাংশ ও এনজিও হাসপাতালে ৩৯ শতাংশ। এবার বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর কয়েক মাস পর তারা তাদের জুলাই মাসের প্রতিবেদনে দাবি করেছেন যে করোনা সংকটের সময়ে বাংলাদেশে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের প্রবণতা কমেছে। আবার সরকারি হিসাবেও দেখা যাচ্ছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল-ক্লিনিক মিলিয়ে গত জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সি-সেকশন বা সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার কমছে। সরকারি হিসাবেই জানুয়ারি মাসে নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৫০ হাজার ৮৭৮টি, যেখানে সিজার হয়েছে ৪৩ হাজার ৮৭৯টি। পরে ফেব্রুয়ারি মাসে সিজার হয়েছে ৩৯ হাজার ৮৩২টি, মার্চ মাসে ৩৭ হাজার ৪১১টি, এপ্রিল মাসে ৩২ হাজার ৫৯১টি, মে মাসে ৩৩ হাজার ৮০৮টি, জুন মাসে ৩৬ হাজার ৯০টি এবং জুলাই মাসে ২৬ হাজার ৮০২টি। পরিবারপরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাবে সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সিজারের সংখ্যা খুবই কম। ফেব্রুয়ারি মাসে এসব হাসপাতালে ১৩ হাজার ৫২৩টি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে আর সিজার হয়েছে ৬১১টি। পরবর্তী মাসগুলোতে সিজারের সংখ্যা আরো কমেছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মার্চ মাসে সিজার হয়েছে ৫১৪টি, এপ্রিলে ২৯৭টি, মে মাসে ২৫৫ ও জুন মাসে ১১ হাজার ৮৫৭টি স্বাভাবিক প্রসবের বিপরীতে ২৯১টি সিজার হয়েছে।
২০১৮ সালের তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলছিল, বাংলাদেশে গত দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এতে বলা হয়েছিল, ২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সিজার বা প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার চার থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সিজারিয়ান নিয়ে এতো বিতর্ক শুরু হয়েছিল যে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তখন হাইকোর্ট সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার রোধ করতে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিল। প্রসঙ্গত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী কোনো দেশে মোট প্রসবের ১০-১৫ ভাগের বেশি সি-সেকশন হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এ হার ৩১ শতাংশ। যদিও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সব প্রসব তথ্য দেশের সব জায়গা থেকে সরকারি হিসেবে আসে না। তাই প্রকৃত অবস্থায় এ হার আরো অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে তাদের।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, এখন সারা বিশ্বে একটাই স্লোগান হওয়া দরকার, আর তা হলো ‘নরমাল ডেলিভারি বাড়াও, কিন্তু হাসপাতালে করাও’। তিনি বলেন, সন্তান ডেলিভারির সময় রোগীর সমস্যা হতে পারে। শিশু উলটো আসতে পারে। অনেক সময় ফুল বের করা নিয়েও সমস্যা হয়। তাই সন্তান প্রসব হাসপাতালেই করা উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, আইন আছে। কিন্তু যারা বাস্তবায়ন করবে তারা সত্ ও নিষ্ঠাবান না হলে লাভ হবে কি? নতুন আইন করেও কী লাভ? অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার দেশব্যাপী আরো কঠোর মনিটরিংয়ে নামানো হবে বলে তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন বলেন, আগামীকাল ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অভিযান চালানো হবে। লাইসেন্স আছে কি না, লাইসেন্স নবায়ন করা কি না, কথায় কথায় সিজার করা হচ্ছে কি না সব কিছু দেখা হবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কুহিনুর বেগম জানান, শ্রীলঙ্কায় গর্ভকালীন মৃত্যুর হার শূন্য। সেখানে হাসপাতালে সন্তান প্রসব বেশি হয়। কথায় কথায় সিজার না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মা ও সন্তানের জন্য সিজার ঝুঁকিপূর্ণ। যখন কোনো বিকল্প থাকে না তখনই সিজার করতে হয়।ইত্তেফাক