কবি রফিক আজাদ তাঁর ‘দুঃখ-কষ্ট’ কবিতায় লিখেছেন- [icon name=”quote-left” prefix=”fas”]পাখি উড়ে চলে গেলে, পাখির পালক পড়ে থাকে…[icon name=”quote-right” prefix=”fas”]
পাখি উড়ে চলে গেলে, পাখির কয়েকটি পালক পূর্বের স্থানে ফেলে যায়। মানুষের মৃত্যু যেন পাখি উড়ে চলে যাওয়ার মতই। মানুষ মরে গেলে কর্মের মাধ্যমে স্মৃতি রেখে যায়। সেই স্মৃতিসমূহ স্মরণ করে মানুষ মৃতব্যক্তির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানায়। এই পৃথিবী থেকে আমাদের সকলকেই চলে যেতে হবে, আগে আর পরে। কেউই থাকবো না। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়, বড় ব্যথা দেয়। কৃষিবিদ পরিবারের আত্মার আত্মীয় তিনজন বরেণ্য জননেতা কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাজাহান; কৃষিবিদ আবদুল মান্নান এবং কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা-র চিরপ্রস্থানের শূন্যতা গ্রাস করেছে বাংলাদেশের সকল কৃষিবিদকে।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ভর্তি হতে গিয়ে তাঁদের সাথে রাজনৈতিকভাবেই আমার পরিচয়। সেই থেকে একসাথে পথ চলা। জনাব শওকত মোমেন শাহজাহান সেসময়ে বাকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন শাহজালাল হলের (পশ্চিম) ২৪ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র, আমি (পশ্চিম) ২২ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র। আমাদের ব্যাচের নতুন ছাত্রদের ছাত্রলীগের পতাকাতলে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রায়ই শাজাহান ভাইকে তাগিদ দিতাম। তিনি বলতেন, ‘I want quality, not quantity.’ তুমি পাঁচটি quality পূর্ণ ছাত্র সংগঠিত করো। দেখবে, ওরাই বৃহৎ ছাত্রলীগকে সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত করবে’। তাঁরা প্রত্যেকেই এমনি জনসম্পৃক্ত নেতা ছিলেন যে, তাঁদের সাথে আমাদের সকল কৃষিবিদদেরই অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে।
প্রয়াত এই তিনজন বরেণ্য কৃষিবিদের স্মরণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গত ১৬ জানুয়ারি ২০২২ স্মরণসভার আয়োজন করেছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ডঃ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি-র সভাপতিত্বে সেই অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী সচিব ও বিভিন্ন সংস্থার চেয়ারম্যান/ ডিজি-সহ অসংখ্য বরেণ্য কৃষিবিদ স্মৃতিচারণ করেছেন।
এসকল গুণীজনদের আলোচনা ও স্মৃতিচারণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তাঁরা শুধু একটি করে নাম নন, কৃষিবিদদের অহংকার ও আশা-ভরসার প্রতীক। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের জন্য নিবেদিত প্রাণ অকুতোভয় রাজনৈতিক নেতারা আপাদমস্তক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেছেন । তিনজন নেতারই ছিল বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য যা প্রয়োজন-তা হচ্ছে নেতৃত্ব, মেনুফ্যাষ্টো বা আদর্শ, নিঃস্বার্থ কর্মী ও সংগঠন’। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান কৃষিবিদ ডঃ শেখ বখতিয়ার বলেছেন, উল্লিখিত সকল গুণাবলীই প্রয়াত এই তিনজন কৃষিবিদ নেতাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
মাননীয় মন্ত্রী এডভোকেট শ ম রেজাউল করিম তাঁর আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, ‘প্রয়াত এই তিনজন জাতীয় কৃষিবিদ নেতা জাতির খুব ক্রান্তিকালে রাজনীতি করেছেন। ক্রান্তিকালে রাজনীতি করার মত সাহস দলের অনেকেই রাখেন না। অনেক ক্রান্তিকালে দেখা গেছে অনেকেই সামনে আসেন না, ঝুঁকিও নেন না। কিন্তু এই তিনজন কৃষিবিদ নেতার রাজনৈতিক জীবনে বর্ণাঢ্য সেই ঐতিহ্য রয়েছে। ক্রান্তিকালকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় সেই পরীক্ষায় তাঁরা উত্তীর্ণ’।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রবল প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে খুনিচক্রের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন কৃষিবিদ জনাব শওকত মোমেন শাজাহান, আব্দুল মান্নান ও বদিউজ্জামান বাদশা। এই তিনজন নেতার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনায় বাকৃবি ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি বরেণ্য কৃষিবিদ আবুল ফয়েজ কুতুবী বলেছেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশে ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানে নেতৃত্ব দিলেও অদৃশ্য কারণে রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশে কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান ও কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা-র রাজনৈতিক জীবন সুখকর হয়নি’।
কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা-র রাজনীতির চারণক্ষেত্র শেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আতিউর রহমান আতিক বলেছেন, ‘সারা বাংলাদেশের কৃষিবিদদের আত্মার আত্মীয় কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা’র জানাজায় লক্ষাধিক মানুষ তারাগঞ্জ স্কুল মাঠে সমবেত হয়েছিল। বাদশা ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ সামনে রেখে স্মৃতিচারণ করার সময় সমবেত এলাকাবাসী ৫-৬ ঘন্টা পিনপতন নীরবতায় দাড়িয়েছিল। আমিও জানাজায় ছিলাম। দুর্ভাগ্য সেদিন তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারের জন্য স্থানীয় আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে মাইকিং করার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয় নাই। এটা ছিল আমার দুর্ভাগ্য। আমি করতে পারি নাই। আমি (জানাজায়) গিয়েছিলাম। আমাদের অনেক নেতা গিয়েছিলেন। মানুষের চোখের পানি আর বুক চাপড়ানো ব্যথা সেদিন আমরা দেখেছি, মর্মে মর্মে আমি উপলব্ধি করেছি, ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর পারে গারো পাহাড়ের পাদদেশে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা, যিনি আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন’।
কৃষিবিদ পরিবারের সদস্য মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘উনারা তিনজনই নিজ নিজ এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিন নেতাই নিজ নিজ সংসারের চেয়ে এলাকার উন্নয়ন, কৃষি পেশার উন্নয়ন ও কৃষিবিদদের কল্যাণে জীবনের বেশীরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। যে যেটুকু করে, তার যদি মর্যাদা দেওয়া হয়, তাহলে সবাই উৎসাহী হয়। সবাই এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে’।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মহান সৈনিক, কৃষিবিদ সমাজের প্রাণের নেতা এই তিনজন রাজনৈতিক নক্ষত্রের প্রয়াণে কৃষিবিদ পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তারা অনন্য সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে নিজেকে এক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ দুঃসময়ে তাঁদের যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে কৃষিবিদ সংগঠনে আওয়ামীলীগের সমর্থক সবচেয়ে বেশি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যে প্রয়াত এই তিনজন নেতা দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা তাঁদের আদর্শকে লালন করে যদি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষিতে সত্যিকার অবদান রাখতে পারি তাহলেই তাঁদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
ড. মোঃ আওলাদ হোসেন, ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী ও কলামিস্ট, ঢাকা, বাংলাদেশ।